কুমিল্লায় যে গ্রামের মানুষদের যেতে হয় না থানায়

পূর্ব নোয়াগাঁও গ্রাম। কুমিল্লার লালমাই উপজেলার বাগমারা উত্তর ইউনিয়নে এর অবস্থান। এই গ্রামটির নামকরণ ঠিক কবে করা হয়েছিল তার সঠিক তথ্য কেউ না দিতে পারলেও স্থানীয় বয়োবৃদ্ধদের দাবি- গ্রামটির বয়স প্রায় ২০০ বছর।

পূর্ব নোয়াগাঁও গ্রামটি দেখেছে বৃটিশ শাসন, সাত চল্লিশের দেশভাগও দেখেছে। এত পুরোনো একটি গ্রাম হলেও এই গ্রামে মামলা হয়নি একটিও। জমি সংক্রান্ত জটিলতাসহ যেকোনো ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান মেলে গ্রামটির সর্দার এবং মাতব্বরদের কাছে। তাই দীর্ঘ সময়েও গ্রামের একটিও মানুষকেও যেতে হয়নি থানা কিংবা আদালতের বারান্দায়।

বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমনই এক সুন্দর সমাজের গ্রাম রয়েছে কুমিল্লার পূর্ব নোয়াগাঁও। বৃটিশ শাসনামলে গ্রামটি জেলার লাকসাম উপজেলাধীন ছিল। ২০১৩ সালে উপজেলা স্থানান্তরিত হলে চলে আসে সদর দক্ষিণ উপজেলার মানচিত্রে। ২০১৯ সালে জেলায় লালমাইকে নতুন উপজেলা ঘোষণা করার পর গ্রামটিকে আনা হয় নবগঠিত লালমাই উপজেলার মধ্যে। ব্যতিক্রমী গ্রামটি লালমাই উপজেলার বাগমারা উত্তর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত। যেখানে ৮৫০ জন মানুষের বসবাস। যার মধ্যে ভোটার সংখ্যা ৪২৩ জন। এত মানুষের বসবাস হলেও এই গ্রামের কারও বিরুদ্ধে একটিও মামলা হয়নি থানা কিংবা আদালতে।

গ্রামের বেশ কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ এসব তথ্য জানিয়েছেন। তবে গ্রামের প্রধান সর্দার আব্দুল মান্নান ব্যক্তিগত কারণে গ্রামের বাইরে অবস্থান করার কারণে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কথা হয়েছে গ্রামের বেশ কয়েকজন মাতব্বরের সঙ্গে।

তাদেরই একজন পূর্ব নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা এবং পূর্ব নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু তাহের। তিনি জানান, আমার পূর্বপুরুষদের জন্ম এই গ্রামে। তারপর আমাদের জন্ম। সেই শৈশবকালেই বাবা-দাদাদের মুখে গ্রামের ইতিহাস শুনতাম। ছেলেবেলা থেকেই দেখতাম গ্রামে কোনো সমস্যা হলে মুরব্বিরা বৈঠক বসিয়ে সমাধান করে দিতেন। আমার পূর্ব পুরুষদের পূর্ব পুরুষেরাও এমনটা করতেন।

বর্তমানে পূর্ব নোয়াগাঁও গ্রামের বয়স ২০০ বছর। এখন পর্যন্ত আমাদের গ্রামে একটিও মামলা হয়নি। আমরা এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছি, যেন কোনো হানাহানি নেই, বিদ্বেষ নেই। যেকোনো ঘটনা ঘটলে গ্রামের সর্দারের নেতৃত্বে বৈঠকে বসে উপযুক্ত ফয়সালা করা হয়, তাতে অভিযোগকারী যেমন খুশি হন, তেমনি অভিযুক্তও খুশি হন। গ্রামের প্রায় ৮০ শতাংশ ঘটনায় এমনটা হয়ে থাকে। বাকি ২০ শতাংশ ঘটনা বড়জোর চেয়ারম্যান অফিস পর্যন্ত যায়। সেগুলো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সমাধান করেন। যার ফলে কাউকে থানা কিংবা আদালতের দ্বারস্থ হতে হয় না।

গ্রামের মাতব্বর বাগমারা উত্তর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাজী অহিদুর রহমান বলেন, আমাদের গ্রামটি একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। আশপাশের সমাজ ব্যবস্থায় দেখি, ঘরে ঘরে মামলা, হামলা। কিন্তু পূর্ব নোয়াগাঁও এমন একটি গ্রাম যেখানে কোনো মামলা নেই। আমাদের পূর্বপুরুষরা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, আমরাও ঐক্যবদ্ধভাবে সমাজে বাস করছি, ভবিষ্যত প্রজন্মকেও তেমনভাবে শিক্ষা দিচ্ছি, যেন তারাও মিলেমিশে সুন্দর এ সমাজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলতে পারে।

বাগমারা উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বলেন, আমার ইউনিয়নের প্রায় সবগুলো গ্রামেই ঝামেলা কম। তবে পূর্ব নোয়াগাঁও গ্রামে তুলনামূলকভাবে কম। মাঝে মধ্যে দু-একটা ঘটনা ঘটে। সর্দার-মাতব্বররা বসে সমাধান করে দেন। কিছু ঘটনা তারা সমাধান না দিতে পারলে আমার কাছে নিয়ে আসেন, আমি গ্রামের সবাইকে নিয়ে মীমাংসা করে দেই। উভয় পক্ষই খুশি থাকে।

লালমাই থানার ওসি মো. হানিফ তালুকদার বলেন, আমি লালমাই থানায় যোগদান করেছি জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে। এ থানায় যোগদানের পর এখন পর্যন্ত পূর্ব নোয়াগাঁও গ্রাম সম্পর্কে তেমন কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে কিছুদিন আগে পূর্ব নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে বিট পুলিশিং মিটিং করেছি। গ্রামের লোকজন আমাকে জানিয়েছেন গ্রামে কোনো মামলা নেই তবে বাইরের কিছু মাদকসেবী এখানে এসে মাদকসেবন করে। পরবর্তীতে আমি সেখানে পুলিশি তৎপরতা বৃদ্ধি করেছি। এখন আর বাইরের মাদকসেবীরা ওই গ্রামে যায় না।

লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফোরকান এলাহী অনুপম বলেন, আমার জানামতে এ গ্রাম থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বিষয়ে অভিযোগ আসেনি। তবুও খোঁজ নিয়ে দেখে বিস্তারিত বলতে পারব।

আরো পড়ুন