কুমিল্লায় জলাবদ্ধ জমিতে ফসলের হাসি
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা সদর, বাকশীমুল, ষোলনল ও রাজাপুর ইউনিয়নের বিশাল অংশের কৃষকের কাছে এক সময় দুঃখের নাম ছিল পয়াতের খাল। এই খালের আশপাশে তিন একর জায়গা কৃষক আবদুল হকের। বছর পাঁচেক আগে সেখানে আউশ ধানের চাষ করেছিলেন তিনি। বর্ষায় খাল উপচে জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এক ছটাক ধানও ঘরে তুলতে পারেননি এ কৃষক। শুধু আবদুল হক নন, এ এলাকার পাঁচ হাজার কৃষকের জমি প্রতি বর্ষায় গত ২০ বছর ধরে ডুবছে। অবৈধ দখল ও অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের ফলে অস্তিত্ব সংকটে ছিল খালটি। ফলে জলাবদ্ধতা আর শুকনো মৌসুমে সেচের অভাবে দীর্ঘদিন অনাবাদি পড়ে ছিল খালটির আশপাশের বিস্তীর্ণ জমি। ছিল জোঁকের উপদ্রব, কচুরিপানা আর আগাছায় ভরে থাকত মাঠ। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) উদ্যোগে সেই পয়াতের খালে এখন প্রাণ ফিরেছে। খাল খননের ফলে আবাদের আওতায় এসেছে আশপাশের জমিও।
জানা গেছে, ২০১৯ সালে বিএডিসি কুমিল্লা-চাঁদপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেচ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। ৩৪ উপজেলায় ৩৬৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প চলবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। এই প্রকল্পেরই অংশ হিসেবে ২০২০ সালে ড্রোনের মাধ্যমে পয়াতের খালের বিস্তীর্ণ এলাকা পর্যবেক্ষণ করা হয়। কোথায় জলাবদ্ধতা কিংবা পানি আটকে থাকে তা করা হয় চিহ্নিত। এরপর দখলমুক্ত করে ২০২১ সালের শুরুতে ২৫ কিলোমিটার পয়াতের খাল পুনর্খননের উদ্যোগ নেয় বিএডিসি। ফলে ২০২১ সালের আগস্ট থেকে সেখানে আউশ ধানের চাষ শুরু করেছেন কৃষকরা। অনাবাদি জমিতে ফলছে অন্তত ৩০ হাজার টন ফসল।
শুধু পয়াতের জলা নয়, বিএডিসির উদ্যোগে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুরের ২৬ হাজার ৯৩৯ হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তিন জেলার ৬১৭ কিলোমিটার মরা খাল খনন করা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে ৪০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ ও ১৯ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ পাইপ। ৪১২ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ সেচনালা এবং ৩০টি সৌরচালিত পাতকুয়া নির্মাণ করা হয়েছে। এতে প্রকল্প এলাকায় প্রতি বছর উৎপাদন হচ্ছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৫ টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য। সুফল পেয়েছেন ১ লাখ ২০ হাজার ৭৯০ জন কৃষক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, আগে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুরের ১ লাখ ৫১ হাজার ৮৮৬ হেক্টর জমি চাষের আওতায় ছিল। খাল খনন ও সেচ সুবিধার কারণে এখন চাষের আওতা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৮২৫ হেক্টর। তিন জেলায় আগে প্রায় ২২ লাখ টন শস্য উৎপাদন হতো, তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৫ টন।
বুড়িচংয়ের পয়াতের জলায় এখন চারদিকে আউশের সোনালি আভা। ক্ষেতের এক দিকে কৃষক ধান কাটছেন, আরেক দিকে চলছে ধান মাড়াই। খনন করা খালে মাছ ধরছেন কেউ কেউ। বুড়িচংয়ের রাজাপুর ইউনিয়নের কৃষক আতিকুল ইসলাম বলেন, দুই বছর আগেও এখানে কোমর সমান পানি ছিল। শুধু বোরো চাষ করা যেত। এক সময় পয়াতের জলা অভিশাপের মতো ছিল। বিএডিসি খাল খনন করায় জলাবদ্ধতা দূর হয়েছে। এখন আমন ও আউশ চাষ করা যাচ্ছে।
বুড়িচংয়ের হরিপুর গ্রামের গিয়াস উদ্দিন মাস্টার বলেন, খাল খননে জমিতে ফসল হচ্ছে, খালে মাছ ধরা যাচ্ছে। খালের পাড়ে হাঁটাচলার রাস্তাও হয়েছে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) কুমিল্লা উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আশিকুর রহমান বলেন, এক সময়ের জলাবদ্ধ ১২ হাজার হেক্টর জমিতে বিনা-১৯ ও বিনা-২১ চাষ হচ্ছে। ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে।
কুমিল্লার চান্দিনার কাজীপাড়া খাল এবং চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কানাইল খালও খনন করায় উপকৃত হয়েছেন দুই উপজেলার তিন হাজার কৃষক। দাউদকান্দির পাদুয়ায় ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কারণে কয়েক হাজার কৃষক আবাদে ফিরেছেন। এ ছাড়া বাঁধটি ঘিরে বর্ষায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া তিনটি গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। দাউদকান্দির বড় হরিণা রামায়েতকান্দিতে ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ পাইপের কারণে কচুরিপানা ও জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছেন বেশ কয়েকটি গ্রামের কৃষক। চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার পালাখাল ইউনিয়নের মেঘদাইর গ্রামের দেড় কিলোমিটার সুন্দরী খাল ৫০ বছর ধরে সংস্কার না করায় পলি ও কাদা জমে ভরাট হয়েছিল। খালটি সংস্কার করায় ৪০০ একর অনাবাদি জমিতে এখন তিনটি ফসল চাষ হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার সাতপাড়া এলাকায় ভরাট খাল খননের কারণে ১০০ বিঘা জমিতে পানি নিতে পারছেন কৃষক।
কুমিল্লা (ক্ষুদ্র সেচ) সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও বিএডিসির কুমিল্লা-চাঁদপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ভূউপরিস্থ সেচের পানির প্রাপ্যতা বাড়ায় ভরাট হয়ে যাওয়া খাল সচল করা জরুরি। আমরা প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তিনটি জেলার খাল, জলাভূমি, ব্রিজ-কালভার্ট পর্যবেক্ষণ করেছি। সে অনুযায়ী অনাবাদি জমিতে তিনটি ফসল ফলাতে যা দরকার তা করেছি। এতে ফসল তিন গুণ বেড়েছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কুমিল্লায় এক সময়ের জলাবদ্ধ জমিতে সোনালি ফসলের ঝিলিক আমি সরেজমিন দেখে এসেছি। এ প্রকল্প সারাদেশের জন্য অনুকরণীয়। কারণ দেশে নদীর নাব্য কমছে। পলি পড়ে খাল ভরাট হয়ে গেছে। খাল খননের ফলে একদিকে জলাবদ্ধতা দূর হবে, অন্যদিকে শুকনো মৌসুমে খালের পানি সেচকাজে ব্যবহার করা যাবে।