কুমিল্লায় গ্রাহকের ২০০ কোটি টাকা নিয়ে প্রতারণা
কুমিল্লার বুড়িচংয়ে হোটেল হক ইন, বিরতি রেস্তোরাঁ এবং মেসার্স নিউ হক ব্রিকস ফিল্ড অ্যান্ড বিজনেস লিমিটেডের মালিক মো. বিল্লাল হোসেন পাঁচ শতাধিক আমানতকারীর কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন ২০০ কোটি টাকা। সময়মতো অর্থ ফেরত না পেয়ে অবশেষে আমানতকারীরা বুড়িচং ও কুমিল্লা আদালতে তার বিরুদ্ধে একাধিক প্রতারণার মামলা করেছেন।
নিজের প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে বিল্লাল গ্রাহকদের অধিক মুনাফা দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছে থেকে আমানত হিসাবে টাকা নিতেন। আমানতকারীর প্রত্যেককে ডকুমেন্ট হিসাবে বিল্লাল নিজের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের চেক দিয়েছেন। পরে আর সেই চেকের টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। আমানতকারীরা পাওনা টাকার জন্য চাপ দিলে তিনি হোটেল হক ইন, বিরতি রেস্তোরাঁ, মেসার্স বিল্লাল ব্রিকস ফিল্ড বিক্রি করে আড়ালে চলে যান। আমানতকারীরা এরপর প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাকে আর খুঁজে পাননি।
প্রথমে কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলা করেন মেসার্স সৈকত কনস্ট্রাকশনের মালিক মো. কেফায়েত উল্লাহ। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, আমি নিউ হক ব্রিকস ফিল্ড থেকে দীর্ঘদিন ধরে ইট কিনে ঠিকাদারিসহ অন্যান্য ব্যবসা করে আসছিলাম। হক ব্রিকস ফিল্ড অর্থের অভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে ব্যসায়িক সুসম্পর্কের সুবাদে এর মালিক বিল্লাল হোসেন ব্রিকস ফিল্ড পরিচালনা ও কয়লা কেনার জন্য আমার কাছে টাকা চান। আমাকে কম মূল্যে ইট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৯ সালের অক্টোবরে তিনি এক কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা বিভিন্ন চেক ও নগদে গ্রহণ করেন। এরপর বিল্লাল হোসেন কিছুদিন ইট ও পিকেট ইট সরবরাহ করলেও পরে নানা ছলে আমাকে ঘোরাতে থাকেন। একপর্যায়ে হিসাব করে আমি টাকা পরিশোধের অনুরোধ করি।
কিন্তু তিনি দেই, দিচ্ছি বলে কালক্ষেপণ করেন। অবশেষে ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সালিশ বৈঠকের মাধ্যমে এক কোটি তেরো লাখ ছেষট্টি হাজার টাকার চেক দেন। পরের দিন আমি চেক ক্যাশ করতে গেলে ব্যাংক থেকে জানানো হয় ওই হিসাবে পর্যাপ্ত টাকা নেই। পরে আমি কুমিল্লা আদালতে মামলা করি। একই ভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার মো. রুহুল আমিন মজুমদার। তিনিও বিল্লাল হোসেনকে ২০১৯ সালের আগস্টে ৮০ লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে দিয়েছেন। কিন্তু নানাভাবে ঘোরানোর পর অবশেষে তাকে ৬০ লাখ টাকার চেক দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই টাকা আর ক্যাশ করতে পারেননি। তিনিও প্রতারণার অভিযোগে কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলা করেছেন।
এভাবে বিল্লাল হোসেন ৫০০ জনের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিল্লাল হোসেনের বাহারি প্রচারণা আর শরিয়তি লেবাসে আকৃষ্ট হয়ে সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হয়েছেন সদর উপজেলার চান্দপুর ডুমুরিয়ার মো. নিজাম উদ্দিন। তিনি আমানত হিসাবে দিয়েছেন ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা। একই উপজেলার কেফায়েত উল্লাহর কাছ থেকে নিয়েছেন ১ কোটি ১৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। সদর উপজেলার বাগিচাগাঁও রানীর বাজারের মো. রুহুল মজুমদারের কাছ থেকে নিয়েছেন ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
বুড়িচংয়ের ভারেল্লার মাওলানা মো. শাহজাহান সাজদী কাছে থেকে নিয়েছেন ১ কোটি ২ দুই লাখ টাকা। নিজাম উদ্দিনের কাছ থেকে নিয়েছেন ৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা। কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার মো. বেলায়েত উল্লাহর কাছ থেকে নিয়েছেন ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। কেফায়েত উল্লাহর কাছ থেকে আবার নিয়েছেন ৫০ লাখ টাকা। মো. রুহুল আমিনের কাছ থেকে নিয়েছেন ৫০ লাখ টাকা। আমিন মজুমদারের কাছ থেকে নিয়েছেন ৮০ লাখ টাকা।
হোটেল হক ইন, বিরতি রেস্তোরাঁ এবং মেসার্স নিউ হক ব্রিকস ফিল্ড অ্যান্ড বিজনেস লিমিটেডের মতো কোম্পানি খুলে বুড়িচংয়ের শাহাদৌলতপুরের আব্দুল হকের ছেলে বিল্লাল হোসেন পাঁচ শতাধিক আমানতকারীর প্রায় দুই শতাধিক কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন। আমানতকারীররা এখন তার নাগাল পাচ্ছেন না।
স্থানীয় বেলায়েত হোসেন জানান, বিল্লাল হোসেন গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে কুমিল্লা বুড়িচং থানা ও কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানা ও কুমিল্লা জেলা দায়রা জজ আদালতে একাধিক প্রতারণার মামলা করা হয়েছে।
প্রতারণার শিকার আমানতকারী কেফায়েত উল্লাহ বলেন, বিল্লাল হোসেন প্রথমে আমার সঙ্গে সুকৌশলে সম্পর্ক তৈরি করেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, আমাকে কিছু দিনের জন্য বন্ধু কয়েক কোটি টাকা দাও। আমি ব্যবসার লভ্যাংশ থেকে তোমাকে লাভ দেব। তার এমন কথায় আমি প্রথমে ১ কোটি টাকা দেই। কিছু দিন সে লাভ দিয়েছে। পরে আমি তাকে আরও ১৩ লাখ টাকা দিয়েছি। কিন্তু কিছু দিন লভ্যাংশ দেওয়ার পর আমি আর তাকে খুঁজে পাইনি। কল করলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে কুমিল্লা আদালতে ও বিভিন্ন থানায় ৩০টিরও বেশি প্রতারণা ও চেক জালিয়াতি মামলা রয়েছে। দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন মামলায় তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। তবে তাকে গ্রেফতার করা হয়নি।
বিল্লাল হোসেনের ম্যানেজার সাঈদ বলেন, ব্যবসায় লোকসান হয়েছে বিধায় গ্রাহকদের টাকা আটকে গেছে। আমরা স্টারলাইনের সঙ্গে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। গ্রাহকদের আস্তে আস্তে টাকা পরিশোধ করার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, কারও কাছ থেকে নিয়েছি ২৪ লাখ। সে যদি ১০ কোটি টাকা দাবি করে, তাহলে কি করার আছে?
বিল্লাল হোসেন এইসব অভিযোগের ব্যাপারে বলেন, আমি যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি তাদের আস্তে আস্তে কিছু টাকা শোধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমার দুটি হোটেল বিক্রি করে দিয়েছি তাদের টাকা পরিশোধ করার জন্য। আমার বিরুদ্ধে অনেকে মামলাও করেছেন।
তিনি বলেন, আমি জেল খেটেছি। আদালত থেকে জামিনে এসেছি। আমি দেশ ছেড়ে পালাব না। তবে অনেকে টাকার পরিমাণ বেশি বেশি বলছেন। মোট টাকার পরিমাণ ২০০ কোটি টাকা হবে না, আরও কম। আমি অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি টাকার লাভও দিয়েছি।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, আমরা তাকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করছি।
সূত্রঃ যুগান্তর