কুমিল্লায় মাফিয়া শাসন, কুমিল্লার অঘোষিত জমিদার

বাহাউদ্দিন বাহার। কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। কেউ বলতেন রাজা। কেউ বলতেন কুমিল্লার অঘোষিত জমিদার। তিনি পদে পদে তার প্রমাণও রেখে গেছেন। ১৫ বছর ধরে কুমিল্লার রাজনীতিতে আকম বাহাউদ্দিন বাহারই ছিল শেষ কথা। তার অনিচ্ছায় শহরে কিছু হতে পারে বেশিরভাগ মানুষই তা বিশ্বাস করেননি। জেলায় অনেক প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রী থাকলেও সদরে বাহারের কথাই ছিল শেষ। দীর্ঘ একযুগে অনেকে বাহারের রোষানলে পড়ে কুমিল্লা শহরে ঢুকতেও পারেননি।

জেলার টেন্ডারবাজি, দখল, চাঁদাবাজি, সিটি করপোরেশন, ইপিজেড, হাসপাতাল, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস আদালত সবই এমপি বাহারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত কুমিল্লায় বাহারের ইশারা ছাড়া কিছুই হতো না। স্থানীয় প্রশাসনও কখনো বাহারের ইচ্ছার বাইরে যাননি। জনশ্রুতি আছে, কুমিল্লার কোন মসজিদের ইমাম কে হবেন তাও এমপি বাহার ঠিক করতেন। প্রশাসনের কেউ কথা বললেই তাকে বদলি করে দিতেন। হুমকি-ধমকিও দিতেন। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব মহিলা লীগ, শ্রমিক লীগ, মৎস্যজীবী লীগ সবই বাহারের হাতে জিম্মি ছিল। সব কমিটিতেই বাহারের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের আধিক্য দেখা গেছে। বাহারের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিকে কুমিল্লা ছেড়ে পালাতে হবে আগে তা কেউ ভাবেনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুমিল্লার ১১টি সংসদীয় আসনের সব ধরনের উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি বাহার ও তার অনুসারীরা নিয়ন্ত্রণ করতেন। কে কোন কাজ করবেন তা বাহারই ঠিক করে দিতেন। এ ছাড়া সরকারি অফিস, ফুটপাথ, ইজিবাইক, অটোরিকশা, বাস ট্রাক, গার্মেন্টস, হাটবাজার, হাসপাতাল, ক্লিনিক, বাসস্ট্যান্ড, সিএনজি স্ট্যান্ড, মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ সবই বাহারের অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কেউ চাঁদা তুলতেন, কেউ আবার বালু, কুলিবিট, মাদক ও ডিশ ব্যবসা করতেন। পরিবহন, নদী ও আবাসন ব্যবসাও তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির কারণে ১৫ বছরে বাহারের সম্পদ বেড়েছে স্রোতের বেগে। একাধিক মার্কেট, শপিং মল, বাড়ি, গাড়ি, গার্মেন্টস, হাসপাতাল, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ ডজন খানেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে সম্পদে কুমিল্লার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের ছাড়িয়ে গেছেন। শুধু একাই নয়। সম্পদ অর্জনে সহায়তা করেছেন তার অনুসারীদেরও। বাহারের অনুকম্পায় সম্পদে ফুলে ফেঁপে উঠেছে তার সহযোগীরা। কেউ কেউ দখল করেছেন একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি। কেউ আবার হিন্দুরের জমি, পুকুর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও দখল করেছেন।

বাহার লীগের দখলে ছিল সব পদ: কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, শ্রমিক লীগ একক নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন এমপি বাহার। অধিকাংশ কমিটিতেই বড় পদে নিজে ও পরিবারের লোকদের রেখেছেন। বাহারের মতের বাহিরে কাউকেই কমিটিতে রাখা হয়নি। পদ পায়নি অনেক ত্যাগী নেতারাও। বলতে গেলে কুমিল্লায় বাহার লীগের একক আধিপত্য চলেছে। বাহাউদ্দিন বাহার কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, চাচাতো ভাই প্রয়াত মেয়র আরফানুল হক রিফাত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক, মেয়ে তাহসিন বাহার সূচনা কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, স্ত্রী নাসরিন বাহার কুমিল্লা ডায়েবেটিক সমিতির সভাপতি ও মহিলা আওয়ামী লীগ সদস্য, ভাতিজা আব্দুল আজিজ সিহানুক কুমিল্লা মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক, সিহানুকের স্ত্রী নুসরাত জাহান শাকিরা মহানগর যুব মহিলা লীগের সহ-সম্পাদক, আরেক ভাতিজা হাবিবুল আলামিন সাদি মহানগর যুবলীগের ১নং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্যানেল মেয়র, চাচাতো ভাইয়ের ছেলে আকাশ ওয়াহিদ মহানগর যুবলীগের সদস্য, আরেক ভাইয়ের ছেলে সায়ের সায়েরিন মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার সম্পাদক, মেয়ে জামাই সাইফুল ইসলাম রনি মহানগর যুবলীগের সদস্য ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যান। ভাগিনা জুনায়েদ সিকদার অপু কেটিসিসিএ চেয়ারম্যান ও মহানগর কৃষক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক।

নামে বেনামে বাহারের যত প্রতিষ্ঠান: ১৫ বছরে এমপি বাহার নামে বেনামে প্রায় ডজন খানেক প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। বাহারের দৃশ্যমান সম্পদের মধ্যে রেয়েছে- মনোহরপুরে ১১তলা সোনালী স্কয়ার আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন, ৯তলা ময়নামতি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ৪তলা টাউন হল সুপার মার্কেট, মেসার্স কনস্ট্রাকশন এন্ড সাপ্লায়ার্স, সোনালী সুইটস, নাইস পাওয়ার এন্ড আইটি, নাসুয়া এসোসিয়েট, মাইন্ড মোভার লি., এ সিক্স লি., এমবি টেক্সটাইল, গোমতি ডিস্ট্রিবিউশন, হোটেল সোনালী, অনাকা মার্কেটিং এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন লি, এমএস কনস্ট্রাকশন এন্ড সাপ্লায়ার। এ ছাড়া কুমিল্লা ইপিজেডের মধ্যে ওয়েস্টিন কারখানার পাশে নির্মাণাধীন ৬তলা সোনালী জিপার নামে একটি কারখানা রয়েছে বাহারের। পাশেই সোনালী ডায়িং নামে আরও একটি কারখানার বেজমেন্ট নির্মাণ কাজ চলছে। এ ছাড়া মেয়ে ও স্ত্রীর নামে ঢাকার উত্তরায় ৩টি ফ্লাট। নিজের নামে কুমিল্লা হাউজিং এস্টেটে ৩টি প্লট, ছোট মেয়ে আজিজা বাহারের নামে দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় ফ্লাট ও বাড়ি আছে বলে বাহারের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। সাবেক এমপি বাহারের সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মিলে আনুমানিক সম্পদের পরিমাণ হবে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার। বাহারকে ব্যবহার করে তার ভাই ভাতিজারাও সম্পদে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। অনুসন্ধানে ভাতিজা মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আব্দুল আজিজ সিহানুকের বিপুল পরিমাণ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার নিজস্ব পরিবহন কোম্পানি রয়েছে। তার নগর পরিবহন নামে ৩০টি বাস ক্যান্টনমেন্ট থেকে সুয়াগাজি পর্যন্ত চলাচল করে।

বাহারের টেন্ডার সিন্ডিকেট: কুমিল্লার সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্ট, ওয়াপদা, ওয়াসা, সমাজসেবা অধিদপ্তর এমপি বাহার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ছিল। প্রতিষ্ঠানগুলোর সব ঠিকাদারি কাজ পেতেন বাহার পরিবার ও সমর্থকদের ৮টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে নিজের নামে মেসার্স কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট সাপ্লাইয়ার, মেয়ে জামাই সাইফুল ইসলাম রনির নামে মেসার্স সাইফুল ইসলাম রনি ট্রেডার্স, ব্যবসায়িক পার্টনার ও কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নাজমুল হাসান পাখির মেসার্স হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড, আরেক পার্টনার মোহাম্মদ আলমের রানা বিল্ডার্স, জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক এনামুল হকের মেসার্স হক এন্টারপ্রাইজ, আবু বকর সিদ্দিকের নামে মেসার্স আরএবি আরসি লিমিটেড, কুমিল্লা মহানগর সেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জহিরুল আলম রিন্টুর মেসার্স ইসলাম এন্টারপ্রাইজ ও কুমিল্লা মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হাসান ইমামের মেসার্স হামিম অ্যান্ড ব্রাদার্স। কুমিল্লার ১১টি উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের সব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করতো এই ৮ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। গত ১০ বছরে এই টেন্ডার সিন্ডিকেট প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার অন্তত ২১১টি প্রকল্পের কাজ পেয়েছে। এই টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে সাবেক এমপি বাহারের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, গত ৪ বছরে সড়ক ও জনপথ বিভাগে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড। কুমিল্লায় শতাধিক ঠিকাদার থাকলেও জেলার মোট কাজের এক-চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করে এই প্রতিষ্ঠান। সড়ক ও জনপথ বিভাগে বাহারের হয়ে কাজ তদারকি করেন ইমামুজ্জামান চৌধুরী শামীম, মিজানুর রহমান ইরান ও গোলাম মাওলা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে সাইফুল ইসলাম রনি, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে জহিরুল ইসলাম রিন্টু, সাদেকুর রহমান পিয়াস, এলজিইডি অফিসে সিরাজ চেয়ারম্যান ও ইকরামুল হক রুবেল, স্বাস্থ্য প্রকৌশলে হাবীবুল আল আমিন সাদী, পানি উন্নয়ন বোর্ডে নাজমুল করিম সেন্টু, আলী মনসুর ফারুক ও মশিউর রহমান লাভলু, গণপূর্ত অধিদপ্তর বাহারের আপন ভাই কুতুবউদ্দিন হেলাল, মির্জা মোহাম্মদ কোরাইশী, আবদুল হামিদ ও আনোয়ার কন্ট্রাক্টর এবং জেলা পরিষদে আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদ। জাতীয় ই-জিপি পোর্টাল থেকে জানা গেছে, গত ৪ বছরে এমপি বাহারে মেসার্স কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট সাপ্লাইয়ের নামে ১ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকার ৮৭টি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড পেয়েছে ১ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকার ৭২টি প্রকল্প। রানা বিল্ডার্স লিমিটেড পেয়েছে ৫৪০ কোটি টাকার ১২টি প্রকল্প। হক এন্টারপ্রাইজ পেয়েছে ৪১টি প্রকল্প যার বাজেট ১৬৯ কোটি টাকা। হাজার কোটি ব্যয়ে নির্মিত কুমিল্লা সার্কিট হাউস, পানি উন্নয়ন বোর্ড বিল্ডিং, পুলিশ লাইন ভবন, কুমিল্লা জেলখানা, আদালত ভবনের নির্মাণ কাজ করছে বাহারের অনুগত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্সের এক নেতার অভিযোগ, ক্ষমতার অপব্যবহার করেই বাহার এসব টেন্ডার বাগিয়ে নিয়েছেন। বাহারকে চাঁদা না দিলে কুমিল্লায় কারও কাজ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। সদরের চকবাজার থেকে সুয়াগাজি পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার ৪ লেন সড়ক নির্মাণের ইজিপি টেন্ডার পান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনডিই। পরে এনডিই’র ইঞ্জিনিয়ারদের মারধর করে কাজ ছিনিয়ে নেন বাহারের সহযোগীরা। গেল বছর ডিসেম্বরে এই ঘটনা ঘটে। জেলা ক্রীড়া সংস্থার অফিসে বসে সব টেন্ডারের ভাগ বণ্টন হয়।

বাহার ও তার সহযোগীদের যত দখল: জমি দখলে সিদ্ধহস্ত এমপি বাহাউদ্দিন বাহার। ১৫ বছরে বাহার ও সহযোগীরা প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার সম্পদ দখল করেছে। ফাঁকা ও বিরোধপূর্ণ জমি পেলেই বাহিনী নিয়ে সেই জমিতে হামলে পড়তেন। দখল হওয়া অধিকাংশ জমিই স্থানীয় হিন্দুদের। কান্দিরপাড় মোড় থেকে একটু দূরে সোনালী ব্যাংকের সামনে মনোহরপুর মৌজায় ৬৬২ নং দাগে এপি ঔষধালয় ও হিন্দুদের প্রায় ৭০ শতাংশ জমি দখল করে সোনালী স্কয়ার নামে ১১তলা রাজকীয় ভবন নির্মাণ করেছেন এমপি বাহার। জমির মালিক ছিলেন শিক্ষক মনিন্দ হালদার, কৈলাশ চন্দ্র দত্ত ও ইন্দ্রভূশন দত্ত। এই জমি উদ্ধারে কুমিল্লা ১ম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা চলছে। মামলা নং-২৩৫। এই ভবনে ফ্লাট কিনে বিপাকে পড়েছেন ক্রেতারা। জমির বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ভবনের ৫২টি ফ্লাট বিক্রি করেও ক্রেতাদের দলিল করে দিতে পারছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রেতা মানবজমিনকে বলেন, আমি ৯তলায় ৮৭ লাখ টাকা দিয়ে একটি ফ্লাট কিনেছি। কিন্তু এখনো দলিল করে দেয়নি। দলিল করতে বললে তিনি কয়েক কিস্তিতে টাকা ফেরত নিতে বলেছেন। কিন্তু দলিল দিতে পারবে না। কান্দিরপাড় মোড়ে লিজের নামে টাউন হলের জমি দখল ৫তলা টাউন হল সুপার মার্কেট নির্মাণ করেছেন। মার্কেট থেকে মাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ভাড়া তোলা হয়। মার্কেটে তার ‘হোটেল সোনালী’ নামে আবাসিক হোটেল রয়েছে। সেখানে এখন ১৫তলা ভবন নির্মাণের চেষ্টা করায় বাধার মুখে পড়েছেন বাহার। এ ছাড়া জমি না দেয়ায় সোনালী স্কয়ারের প্রবেশপথে শরিফ ট্রেডার্সের ৩টি দোকান দখল করে দুই বছর ধরে তালা মেরে রাখেন বাহার অনুসারীরা। দোকান মালিক রাসেল আহমেদ পুলিশ সুপার, ডিসি ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর অভিযোগ দিয়েও কাজ হয়নি। রাসেল আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, আমরা নুর উর রহমান মাহমুদ তানিম ভাইয়ের বাসায় গেছি সেই অজুহাতে এমপির পিএস ইকবাল দোকানে তালা দিয়েছে। ভয়ে এখনো দোকান খুলতে পারিনি। আসলে মার্কেটের জন্য জায়গা চেয়েছিল আমরা দেইনি দেখে দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। রামঘাট জেলা আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে আরএস ২৮৫ নং দাগে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ১০ শতাংশ জমি জালিয়াতি করে নিজের নামে নিয়ে ৯তলা মহানগর আওয়ামী লীগের অফিস নির্মাণ করেন বাহার। ভবনের ৩টি ফ্লোরে গেস্ট হাউজ, আবাসিক হোটেল, জিমনেশিয়াম, ক্যাফেটেরিয়া ও স্পোর্টস কর্ণার করেছে। সেখানে মাসে প্রায় ২০ লাখ টাকা ভাড়া তোলা হয়। কেউ কেউ এই ভবনকে সোনালী স্কয়ার-২ নামেও ডাকেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট গোলাম ফারুক মানবজমিনকে বলেন, জমিটি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের। সেই জমি একজন ব্যক্তি লিখে দেন কীভাবে? দলিল দেয়ার সময় দাতা সফিউল আহাম্মদ বাবুল ২০১৭ সালের জুলাইতে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারই ছিলেন না। তাহলে সে কোন ক্ষমতা বলে মুক্তিযোদ্ধাদের জমি লিখে দেন। এই দলিল পুরোটাই জাল ও অবৈধ। আমরা বিষয়টি ডিসিকে জানিয়েছি। এ ছাড়া কান্দিরপাড়ে পরিত্যক্ত লিবার্টি সিনেমা হলের ৭০ শতাংশ অর্পিত সম্পত্তি দখল করেন বাহার। অভিযোগ আছে, এজন্য তিনি জমির মূল মালিক রাম চাঁদ ক্ষেত্রীর সন্তান সাজিয়ে ভারত থেকে বিধান সাহা নামের এক ব্যক্তিকে এনে এনআইডি করে জমি দলিল করে নেয়ার চেষ্টা করনে। পরে ধরা পড়ে যাওয়ায় সাব-রিজিস্ট্রার অফিসে নিজের অনুসারী আবুল বাসার সাজ্জাদকে দিয়ে জোরপূর্বক রেকর্ড রুমে ঢুকে অফিস সহকারী ছামাদকে জিম্মি করে দলিল ঘষামাজা করে আকার পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা হয়। মামলা নং-১৫(১১)২০। নগরীর কালিবাড়ির একটি প্রাচীন স্কুল দখল করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন বাহার। এ ছাড়া কুমিল্লা টাউন হল পাঠাগারের পেছনে একটি পুকুর লিজের নামে দখল করে ভবন নির্মাণের চেষ্টা করার মধ্যেই পালাতে হলো বাহারকে। কুমিল্লা ক্লাবও বাহারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই ক্লাব থেকে প্রতি মাসে ২০ লাখ টাকা আয় হয়। তবে টাকার হদিস থাকে না। ছাতিপট্টি বজ্রপুর মৌজায় বিএস ১৪১৭৬ নং দাগে দশপূজা কালিবাড়ি মন্দিরের ২৬.৫ শতাংশ জমি দখল করে বাউন্ডারি দিয়ে রাখা হয়। সাবেক এমপি বাহারের অনুসারী নান্টু মল্লিকের নেতৃত্বে ভুয়া ছেলে নিয়ে এই জমি দখল করা হয়। এই জমি নিয়ে ৩য় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা চলছে। মামলা নং-৮০/১৫। রিভিশন নং-১৮/২৩। এ বিষয়ে মহানগর পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানিক কুমার ভৌমিক মানবজমিনকে বলেন, যারা দখলের সঙ্গে জড়িত, তারা সবাই সাবেক এমপির লোক। এমপির সভা সমাবেশে সম্মূখসারিতে এরাই থাকে। বাহারের ইশারা না থাকলে মন্দিরের জমি দখলের এত সাহস তাদের কখনোই হতো না। হয়তো বাহার সব জানেন। এমপি হওয়ার পরে ২০১০ সালে কুমিল্লা ডায়বেটিক হাসপাতাল দখলে নেন বাহার। দখলে নিয়ে স্ত্রী নাসরিন বাহারকে হাসপাতালের সভাপতি করেন। বর্তমান এই হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টাকা আদায় করা হয়। হাসপাতালের কেনাকাটা, প্যাথলজি সব বাহারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ ছাড়া আলেখারচরে ৫তলা বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতি ও চক্ষু হাসপাতালটি ২০১৮ সালে দখলে নেয়া হয়। এই হাসপাতালে নিজের লোককে বসিয়ে টাকা তোলা হয়। বছরে প্রায় ৫০ লাখের বেশি টাকা আসে এই হাসপাতাল থেকে। ভিক্টোরিয়া ’ল কলেজের সামনে জেলা তথ্য অফিসের জমি জোরপূর্বক লিজ নিয়ে ৯তলা ভবন করে নিজের লোকজনকে রুম বরাদ্দ দিয়েছে সাবেক এমপি বাহার। অভিযোগ আছে, ’ল কলেজে আধুনিক ক্লাসরুম দেয়ার কথা বলে এই ভবন লিজ নেয়া হয়। এ ছাড়া কুমিল্লা পার্ক রোডের সামনে বাদুরতলা রাস্তা দখল করে ১০টি দোকান বানিয়ে তা ভাড়া দিয়ে রেখেছিলেন বাহার। এ ছাড়া স্টেডিয়ামের প্রবেশপথে ৩টি দোকান নির্মাণ করে ভাতিজা আব্দুল আজিজ সিহানুককে দিয়েছেন। রাজগঞ্জ দেশালীপট্টিতে কেটিসিসিএ’র সমবায় মার্কেট দখল করে রেখেছেন বাহারের ভাগিনা জুনায়েদ সিকদার অপু। ৩তলা মার্কেটের প্রায় ৮০টি দোকান থেকে মাসে ভাড়া তুলে নিজের পটেকে ভরেছেন অপু। সমবায়ের সদস্যরা প্রতিবাদ করে একাধিকবার মারধরের শিকার হয়েছেন।

ফুটপাথ, ইজিবাইক, বাস ট্রাক থেকে আদায় ৫০ কোটি: কুমিল্লা শহরের ফুটপাথ, হাটবাজার, সিএনজি, অটোরিকশা, ইজিবাইক, বাস-ট্রাক, কুলিবিট, বাড়িঘর নির্মাণে চাঁদা, ময়লা নিয়ন্ত্রণ করে বছরে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হতো। চাঁদার এক এক স্পট নিয়ন্ত্রণ করতেন এক এক জন। তবে পুরো শহরের প্রধান নিয়ন্ত্রক ছিলেন বাহাউদ্দিন বাহার। মুরাদপুর হাউজিং এস্টেট নিয়ন্ত্রণ করতেন আব্দুর রহমান শহিদ, চকবাজার এলাকার কাউন্সিলর সাইফুল বিন জলিল ও রোকনউদ্দিন রোকন, পুলিশ লাইন থেকে ঝাউতলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাদিকুর রহমান পিয়াস, আদালতপাড়া ও কাপ্তান বাজার জহিরুল ইসলাম রিন্টু, রেসকোর্স থেকে বাদশা মিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন সরকার মো. জাবেদ, শাশনগাছা ও দুর্গাপুর সদর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহমেদ নিয়াজ পাভেল। কান্দিরপাড় থেকে রাজগঞ্জ বাজার মহানগর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিবুল আলম সাদি, মোগলটুলি থেকে ছাতিপট্টি আনোয়ার হোসেন মিঠু ও দেলোয়ার জাকির, টমসম ব্রিজের আশপাশের এলাকা একক নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগ নেতা নাজমুল হাসান শাওন, আশ্রাফপুর, বিশ্বরোড দেখেন রাসেল ও অপু, কুমিল্লা রেল স্টেশন ও ধর্মপুর নিয়ন্ত্রণ করতেন আমিনুল ইসলাম মিঠু, রানিরবাজার ও তালপুকুরপাড় স্বপন, টুটুল ও মুন্না, পদুয়ার বাজার স্টেশন নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগ নেতা অপু, জাঙ্গালীয়া বাসস্ট্যান্ড ও টার্মিনাল যুবলীগের ক্রীড়া সম্পাদক আবু সালেহ বাসেল। শহরে চাঁদার প্রধান স্পট ছিল সাব রেজিস্ট্রার অফিস। খাজনা খারিজ, হেবা দলিল, তারিখ ভুল, নাম ভুল, ব্যাকডেটে দলিল, বয়স পাল্টে দেয়া, বিএসে ভুলেও দলিল হওয়া, মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে দলিল হয়। এখানে দৈনিক প্রায় ২০ লাখ টাকার লেনদেন হয়। টাকা তুলতেন ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম সারোয়ার শিপন। সম্প্রতি কুমিল্লা শিতলভাণ্ডার মিষ্টির দোকান দুইমাস বন্ধ রাখেন বাহারের লোকজন। অভিযোগ, বাহারের ভাতিজা ছাত্রলীগ নেতা সিহানুক শিতলভাণ্ডার থেকে ৫০ লাখ, মাতৃভাণ্ডার থেকে ৮০ লাখ, ভগবতি পেড়াভাণ্ডার থেকে ৩০ লাখ, মুসলিম সুইটস থেকে ২ লাখ এককালীন চাঁদা নিয়ে দোকান তাদের চালাতে অনুমতি দেন।

যেভাবে গোমতী নদী বাহারের নিয়ন্ত্রণে: গোমতী নদীর কমপক্ষে দেড়শ’ পয়েন্ট দিয়ে ড্রেজার লাগিয়ে দিনেরাতে বালু ও মাটি উত্তোলন করে বিক্রি করেছে সাবেক এমপি বাহারের অনুসারীরা। বিক্রি হয়েছে গোমতীর চর ও বাঁধ। প্রতি শতক ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা দরে এই জমি বিক্রি করা হয়। সাদা স্ট্যাম্পে লিখে দেয়া হয় এই জমি। কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার টিক্কারচর এলাকায় সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, কোথাও ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন হচ্ছে। কোথাও নদীর বাঁধের ভেতরের ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। আবার কোথাও নদীর বাঁধ ও সড়ক কেটে পাইপ দিয়ে বালু ফেলে জলাশয় ভরাট চলছে। শুধু টিক্কারচর ও বানাসুয়া পয়েন্ট থেকে কোটি কোটি ঘনফুট মাটি কেটে নেয়া হয়। এতদিন বালু ও মাটি কাটার কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন সদর দক্ষিণ থানার পাঁচথুবী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাছান রফি রাজু। তিনি বাহার সমর্থিত চেয়ারম্যান। ট্রাক ভরে মাটি যাচ্ছে সাকুরা ব্রিক্‌স, তিতাস, রাজা মিয়া ব্রিক্‌স ফিল্ড, ইয়াসিন ব্রিক্‌স, সাকুরা-২ ইটভাটায়। প্রতি ট্রাক্টর মাটি ২২০০ টাকা, ডাম্প ট্রাক ৩০০ টাকা বিক্রি করা হয়। দৈনিক প্রায় ৫০ থেকে ৭০ ট্রাক মাটি সরিয়ে নেয়া হয়। এতে বছরে প্রায় ৩০ কোটি টাকার মাটি ও বালু সরিয়ে নেয়া হয়। এই পুরো টাকাই বাহারের পকেটে যেতো।

হিন্দুদের পুকুর ভরাট করে প্লট বিক্রি: বাহার এমপি হওয়ার পরে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা শহরের প্রায় ৩৭টি পুরোনো পুকুর ও দীঘি দখল করে ভরাট করা হয়। সাবেক এমপি নিজে ও তার সহযোগীরা এই দখলে জড়িত ছিলেন। অভিযোগ আছে, প্রতি পুকুর ভরাট করে ৫০ শতাংশ প্লট দিতে হতো বাহারকে। গেল বছর ঘোষপাড়ার কালীমন্দির সংলগ্ন প্রায় এক একর আয়তনের একটি পুকুর ভরাট করে দখল করা হয়। কাউন্সিলর মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বাবুল এই পুকুর দখল করে নেন। ২০১৮ সালে কুমিল্লা খ্রিস্টানপাড়ার পুকুর দখল করে গোমতী নদী থেকে বালু এনে ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আহসান রোমেল। সাম্প্রতিক সময়ে পর্যায়ক্রমে মাটি ভরাট করে যেসব পুরোনো পুকুর দখলে নেয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে। বাগিচাগাঁও, অশোকতলা, রাজগঞ্জ পানপট্টি, পদুয়ারবাজার বিশ্বরোড এলাকার পুকুর, দক্ষিণ চর্থার একাধিক পুকুর, চকবাজার বাস টার্মিনাল সংলগ্ন পুকুর, ঠাকুরপাড়া, মদিনা মসজিদ রোড এলাকার পুকুর, জোড়পুকুর বিষ্ণুপুর, কালিয়াজুড়ি, ছোটরা, স্টেশন রোড বিআরটিসি বাস টার্মিনাল সংলগ্ন পুকুর, বাগিচাগাঁও মসজিদ সংলগ্ন পুকুর, ধর্মপুর রেলগেট সংলগ্ন পুকুর, ধর্মপুর খাদ্য গোডাউন সংলগ্ন পুকুর, প্রফেসরপাড়া, হাউজিং এস্টেট এলাকায় আমদীঘি। দখল হওয়া পুকুর উদ্ধারে জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ আন্দোলন করে কাজ হয়নি। এসব পুকুরের জমি শত শত কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়েছে।

যার আশ্রয়ে হত্যা মামলার আসামিরা: ২০০১ সালে ভিক্টরিয়া কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক দুলাল হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ছিলেন বাহার। পরে ২০১৮ সালে দুলাল হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনকেও হত্যা করা হয়। ১৯৯৮ সালে জাহিদ বাবু হত্যা মামলার প্রধান আসামি আনোয়ার হোসেন মিঠু বাহারের প্রধান সহযোগী ছিলেন। ২০১৭ সালে জিলানী হত্যার প্রধান আসামি চিকে সহিদ ও ২নং আসামি ২৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসানও বাহারের অনুসারী ছিলেন। এ ছাড়া ১৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সোহেল হত্যা, আক্তার হত্যা, সুমু হত্যাও বাহারের ইশারায় হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

কুমিল্লা ইপিজেডে লুটপাট: বাহার ও তার অনুসারীদের চাঁদাবাজির বড় স্পট ছিল কুমিল্লা ইপিজেড। ইপিজেডের ৯৭টি নিটিং, প্রিন্টিং, ডায়িং, লেদার, জিপার কারখানার সমস্ত ওয়েসটেজ ও ঝুট নিয়ন্ত্রণ করতেন এমপি বাহারের অনুসারী ১৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসেম। ইপিজেজ থেকে ঝুটের ট্রাক বের হলেই ট্রাক প্রতি ২ লাখ টাকা দিতে হতো। এতে দৈনিক অন্তত ১০টি ট্রাক থেকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হতো। চাঁদার টাকা বাহারের জামাতা সাইফুল ইসলাম রনির হাত ঘুরে বাহারের মেয়ে সূচনার কাছে চলে যেতো। কারখানার বর্জ্য শোধনাগার বন্ধ রেখে বর্জ্য খালে ছেড়ে দিতে সহায়তা করায় ইপিজেড থেকে মাসে প্রায় ৭ কোটি টাকা তুলে নিতেন বাহারের ভাগিনা সহিদ ওরফে চিকে সহিদ।

কুমিল্লা স্টেডিয়াম সিন্ডিকেট: ২০১৫ সালে কুমিল্লা স্টেডিয়াম আধুনিকায়নের জন্য ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেন লোটাস কামাল। তবে ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো কাজ হয়নি। বরাদ্দের টাকাও লোপাট হয়ে গেছে। এমনকি স্টেডিয়ামের বিভাগীয় খেলায় লোটাস কামাল প্রধান অতিথি হলেও তাকে কুমিল্লায় ঢুকতে দেয়নি বাহার সমর্থকেরা। স্টেডিয়ামের সিঁড়ির নিচে প্রায় দেড় শতাধিক দোকান রয়েছে। এসব দোকানের মাসিক ভাড়ার প্রায় ১০ লাখ টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে নিতেন বাহারের লোকজন। স্টেডিয়াম উন্নয়ন তহবিলের টাকাও নয়ছয় করার অভিযোগ আছে বাহারের বিরুদ্ধে।

কুমিল্লা হাসপাতাল, মেডিকেলও জিম্মি: ১০ বছর ধরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কুমিল্লা সদর হাসপাতালে সব ধরনের কেনাকাটায় যুবলীগের আহ্বায়ক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদের নজরদারিতে হতো। দরপত্র ছাড়া মালামাল কেনা, বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে সার্জিক্যাল রিকুইজিট কেনা, স্টাফদের খাবার সাপ্লাই, আউটসোটিংয়ের নিয়োগ বাণিজ্য, নির্মাণ কাজ, প্যাথলজি বিভাগে আদায় করা টাকা লোপাট, লিনেন ধৌতকরণ সবকিছু সহিদের হাত ধরেই হতো। অভিযোগ আছে তারা হাসপাতাল থেকেই মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি করতেন। এই টাকা সহিদের হাত ধরে বাহারের কাছে চলে যেতো। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ বছরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নির্মাণ কাজ কেনাকাটার আড়ালে সাবেক এমপি বাহার প্রায় ৬২০ কোটি টাকা নিয়েছেন।

এক রাতে ১৭৬৫ গায়েবি প্ল্যান পাস: কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি একদিনে ১৭৬৫টি ভবন নির্মাণের প্ল্যান পাস করা হয়। ওই সময়ের কুসিক প্যানেল মেয়র বাহারের ভাতিজা হাবিবুল আলামিন সাদি এই প্ল্যান অনুমোদন দেন। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচনের আগে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে এক রাতে এই বিপুল প্ল্যান অনুমোদন দেয়া হয়। জোর করে ইমারত কমিটিকে দিয়ে এই প্ল্যান পাস করে নেন বাহার। এর আগে স্বর্ণ কুঠির, এমআরসি সিলভার, জমজম টাওয়ারকে নকশা বহির্ভূত প্ল্যান অনুমোদন দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের অভিযোগ আছে বাহারের বিরুদ্ধে।

শহরের ইন্টারনেট, ডিশ ব্যবসা: কুলিল্লা সিটি করপোরেশনের সিসিটিভি, ই-ট্রেড লাইসেন্স, সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের আইটি সার্ভিস দেন সাবেক এমপি বাহারের মেয়ে আয়মান বাহার সোনালীর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নাইস আইটি এন্ড পাওয়ার লি.। এ ছাড়া কুমিল্লা শহরের ডিশ ও ইন্টারনেটসেবা এককভাবে কার্নিভ্যাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। সরকার পতন হলেও এখনো তারাই সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক এমপির জামাতা সাইফুল ইসলাম রনি।

বাহার পরিবারের যত গাড়ি: এমপি বাহার, বড় মেয়ে তাহসিন বাহার সূচনা, মেজ মেয়ে আয়মান বাহার সোনালী, স্ত্রী নাসরিন বাহার প্রত্যেকে আলাদাভাবে একাধিক গাড়ি ব্যবহার করেন। বাহার পরিবারের বিভিন্ন নামিদামি ব্রান্ডের অন্তত ৭টি গাড়ি আছে। প্রাডো, প্রিমিও, আরভি-৪, হ্যারিয়ার, ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৪৩০৮, ঢাকা মেট্রো গ-২৫-৯০৬৪, ঢাকা মেট্রো ১৭-১১৯২ গাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একক নিয়ন্ত্রণ: বাহার এমপি হওয়ার পরে প্রথমেই কুমিল্লার সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের দখলে নেন। স্কুল কলেজের কমিটিতে নিজের লোকদের বসান। কমিল্লা জেলা স্কুল, ফয়জুন্নেসা স্কুল, শৈলরানি দেবী হাইস্কুল, মডার্ন হাইস্কুলের ভর্তি বাণিজ্য বাহারের মেয়ে তানসিন বাহার সূচনা নিয়ন্ত্রণ করতেন। জানা গেছে, জিলা স্কুল ২০টি, ফয়জুন্নেছা ৩০টি সিট বাহার নিজেই দখলে রেখেছিলেন। প্রতি বছর এসব সিটের বিররীতে প্রায় ১০ লাখ টাকা সাবেক এমপির কাছে যেতো। গেল বছর কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলায় বদলি হওয়া ৩১ সহকারী শিক্ষক নতুন কর্মস্থলে যোগদানে বাধা দেন এমপি বাহার। পরে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে নিয়োগ পান তারা।

পরিত্যক্ত ভবন ভাড়া দিয়ে কোটি টাকা: কুমিল্লা শহরের সব পরিত্যক্ত সরকারি স্থাপনা দখলে রেখেছিলেন দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আতিকুল্লাহ খোকন। তিনি বাহারের ডান হাত বলেই পরিচিত ছিলেন। কৃষি ব্যাংক, ফুলার হোস্টেল, লিবার্টি সিনেমা হল, কামিনী কুটির, অশোকতলার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, জাতীয় মহিলা সংস্থার কার্যালয়, কান্দিরপাড় লাকসাম সড়কের বিএমএ ভবন, এম ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোম্পানির ভবন, ধর্মসাগরপাড়ের কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয়, ঠাকুরপাড়ার মৃণালিনী দত্ত ছাত্রীনিবাস, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরের ৩টি ভবন, বাগিচাগাঁওয়ের গণপূর্ত বিভাগের কোয়ার্টার, মনোহরপুরের জমি বন্ধকী ব্যাংক তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। জরাজীর্ণ ঝুঁকিপূণ এই স্থাপনা ভাড়া দিয়ে নিজেই টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সরজমিন দেখা যায়, দীর্ঘ একযুগ আগেই রাজগঞ্জ এলাকার রাজবাড়ী কম্পাউন্ড-সংলগ্ন একটি দ্বিতল জরাজীর্ণ ভবনের নিচতলায় অন্তত ২০টি দোকানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একই চিত্র নগরীর ব্যস্ততম কান্দিরপাড় এলাকার পূবালী ব্যাংক ভবনের নিচতলার। এ ভবনের উপরের ৩টি অংশে ‘স্থাপনাটি ঝুঁকিপূর্ণ’ লেখা থাকলেও অন্তত ১৫টি দোকানে ব্যবসা চলছে ঝুঁকি নিয়েই।

কেটিসিসিএ’র কোটি টাকা লুটপাট: কোতোয়ালি থানা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ এসোসিয়েশন (কেটিসিসিএ)র বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুটপাট হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৪ একর জমির অধিকাংশই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে লিজ ও ভাড়া দেয়া হয়েছে। কেটিসিসিএ’র পুকুর, ভবন, হলরুম ভাড়া দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়। পুরো প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ করতেন বাহারের ভাগিনা যুবলীগের আহ্বায়ক সহিদ ওরফ চিকে সহিদ। এই প্রতিষ্ঠানের সম্পদ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাহার তার ভাগিনা জুনায়েদ সিকদার অপুকে কেটিসিসিএ’র চেয়ারম্যান বানিয়ে রেখেছিলেন। নির্বাচন ছাড়াই তাকে জোরপূর্বক চেয়ারম্যান বানানো হয়। জানা গেছে, কেটিসিসিএ’র বছরে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা আয় আছে। ধুলিপাড়া ফান টাউনের অপর পাশে কেটিসিসিএ’র জমি দখল করে বিল্ডিং নির্মাণ করেছেন বাহারের ভাগিনা। এ ছাড়া কুল্লিায়ার মদ খেয়ে পূজা মণ্ডপে আসলে পুলিশে দেয়া হবে মন্তব্য করে দেশব্যপী সমালোচিত হন সাবেক এমপি বাহার। পরে এই নিয়ে হিন্দুরে মধ্যে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ভারত থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। এ ছাড়া পাহাড় কাটায় প্রতিবাদ করার পরিবেশ অধিদপ্তরে উপ-পরিচালকে ১৫ দিনের মধ্যে কুমিল্লা ছাড়ার নির্দেশ ও অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে আলোচিত হন সাবেক এই এমপি।

জানতে চাওয়া হলে সাবেক সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেন, বাহার বেপরোয়া ছিলেন। কিছুই কেয়ার করতেন না। নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান মনে করতেন। সে কুমিল্লা শহরে এমন একটি ভীতির সৃষ্টি করেছিলেন, যেখানে উনি যা করবেন সেটাই সঠিক ছিল। কেউ তার বিরুদ্ধে যেতে চাননি। শহরের সব চাঁদাবাজি, দখলবাজি তার লোকেরাই করতেন। তার ভাতিজা, জামাই ও মেয়েরা এসব নিয়ন্ত্রণ করেছেন। কুমিল্লা শহরে তার অনিয়নম অবিচারের বিরুদ্ধে একমাত্র আমিই সোচ্চার ছিলাম।

অভিযোগের বিষয়ে এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের বক্তব্য জানতে তাকে ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা দিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।

সূত্রঃ মানবজমিন

আরো পড়ুন