কাঙ্ক্ষিত বরাদ্দ পাচ্ছি না মামলার আতঙ্কে আছি – সাক্কু
ডেস্ক রিপোর্টঃ ‘বিএনপির মেয়র বলে আমি চরমভাবে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছি। নানা কারণে নগরীর কাক্সিক্ষত উন্নয়ন এগোচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ পাচ্ছি না। জাইকার কিছু বরাদ্দ দিয়ে নগরীর প্রধান সমস্যা ড্রেনেজ ব্যবস্থা, খাল খননসহ কয়েকটি জরুরি কাজ কোনোমতে চালিয়ে যাচ্ছি। অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও কুমিল্লাকে এগিয়ে নিতে এবং নগরবাসীকে সেবা দিতে কাজ করে যাচ্ছি।’ এভাবেই কথাগুলো বলেন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের (কুসিক) দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত বিএনপি দলীয় মেয়র মনিরুল হক সাক্কু।
এর আগে টানা ২ বার পৌরসভার চেয়ারম্যান ও মেয়র, পরে সিটি কর্পোরেশনের দু’বারের মেয়র সাক্কু আরও বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগ-বিএনপির অনেক নির্দোষ ব্যক্তির মতো আমাকেও সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি মামলায় জড়িয়েছে। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর আদালত কর্তৃক আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি। নগরভবনের সীমিত সম্পদ, নগরবাসীর দেয়া হোল্ডিং ট্যাক্স, আর বিদেশি কিছু বরাদ্দ দিয়ে কোনোরকম এ সিটি কর্পোরেশনকে চালাচ্ছি। কিন্তু এখনও প্রতিনিয়ত মামলা ও নানাভাবে হয়রানির আতঙ্কে দিন কাটাতে হচ্ছে। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে মেয়র বলেন, দুদকের করা এ হয়রানিমূলক মামলার কারণে আমি ইশতেহার অনুযায়ী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে পারছি না এবং এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া গেলে নগরবাসীকে নিয়ে একটি আধুনিক ও সমৃদ্ধ নগর প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে পারব।
জানা যায়, সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার পর দেশের অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনে যে হারে উন্নয়ন হয়েছে কুমিল্লা সিটির ক্ষেত্রে এ ধরনের উন্নয়ন দেখতে পায়নি নগরবাসী। এ নিয়ে নগরবাসীর মাঝে ক্ষোভেরও কমতি নেই। তবে নানা সীমাবদ্ধতা এবং বৈষম্যের মাঝেও নগরীর বিভিন্ন খাতের আয় এবং সরকারের ছোটখাটো বরাদ্দ ও বৈদেশিক বরাদ্দ দিয়ে কোনোরকম এ সিটিকে পরিচালনা করছেন বলে জানিয়েছেন বিএনপিদলীয় দু’বারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার পর ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি এ সিটির প্রথম নির্বাচনে সাক্কু কুমিল্লার প্রবীণ রাজনীতিক ও আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ আফজল খানকে হারিয়ে সিটি মেয়র নির্বাচিত হন। পরে দলীয় প্রতীকে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ এ সিটির ২য় নির্বাচনে আফজল কন্যা সীমাকে হারিয়ে তিনি ফের মেয়র নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করেন।
অপরদিকে অনিয়ম, দুর্নীতি ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে সাক্কুর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সে সময় তিনি আত্মগোপনে থাকায় গ্রেফতার হননি। দুদকের দায়ের করা ওই মামলায় ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল এ চার্জশিটটি আমলে নিয়ে সাক্কুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এতে দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তার শপথ গ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়লে তিনি ফের লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। পরে ৯ মে আদালতে হাজির হয়ে তিনি জামিন লাভ করেন এবং ১১ মে প্রধানমন্ত্রীর কাছে শপথ গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রীকে পা ছুঁয়ে সালাম করে আবারও চমক সৃষ্টি করেন। কুমিল্লা মহানগর বিএনপিতে সাক্কুর রয়েছে একটি নিজস্ব বলয়। তিনি সরকার দলের সঙ্গে আঁতাত করে কুমিল্লায় আধিপত্য বজায় রাখছেন, বিএনপির একপক্ষের এমন অভিযোগের জবাবে সাক্কু বলেন, নগরীর উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলাসহ প্রশাসনিক নানা কর্মকাণ্ডের কারণে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে বিভিন্ন সভায় আমাকে অংশ নিতে হয়। আমাকে পছন্দ করে না এমন লোকজনই এসব বৈঠকগুলোকে পুঁজি করে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
নগরীতে অনুমোদিত নকশাবহির্ভূত বাড়ি নির্মাণ, প্ল্যান পাসের সময় সিভিল এভিয়েশন, পরিবেশ অধিদফতর এবং ফায়ার সার্ভিসের ভুয়া সনদ ব্যবহার প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, বাড়ি ও স্থাপনার অনুমোদন গ্রহণকারীরা অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এসব বিষয়ে দুদক আমার কাছে তথ্য চেয়েছে। আমি দুদককে সব তথ্য সরবরাহ করেছি। অনুমোদনবিহীন বাড়ির বর্ধিত অংশ এবং অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি। বিরোধী রাজনৈতিক দলের মেয়র বলে কথা, তাই অনেক ক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারি না। একমাত্র সরকার সহযোগিতা করলেই সিটি আইন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
নগরীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে মেয়র সাক্কু বলেন, কুমিল্লা একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এ শহরে জলাবদ্ধতা এবং যানজট সমস্যা দীর্ঘকালের। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব সমস্যা সমাধানের জন্য বিগত সময়ে কিছু কাজ করেছি বলেই জলাবদ্ধতা ও যানজট কিছুটা কমেছে। শহরকে জলাবদ্ধতা ও যানজটের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ও স্থায়ী ব্যবস্থার জন্য আমি কাজ করে যাচ্ছি। এই লক্ষ্যে গৃহীত মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে এবং আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে তা সম্পন্ন হলে কুমিল্লা শহর জলাবদ্ধতা ও যানজটমুক্ত হবে। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে নগরীর পার্শ্ববর্তী খালগুলো সংস্কারের কাজ চলছে। যানচালকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় যানজট নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছি। এতে পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি ওভারপাস এবং ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনাও আমার আছে। ইতিমধ্যে নগরীর শাসনগাছা এলাকায় ওভারপাস নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরও ২টি ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, গত ৫ বছরে মহানগরীর কোথাও হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি করা হয়নি, বরং দরিদ্র এবং নানা কারণে পুরো হোল্ডিং ট্যাক্স প্রদানে অক্ষম নাগরিকদের হোল্ডিং ট্যাক্স কমিয়ে পরিশোধের সুযোগ দেয়া হয়েছে। আগামীতেও কোনো নাগরিকের হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি করা হবে না। সিটি কর্পোরেশন থেকে নতুন কোনো করের বোঝাও কারও ওপর চাপানো হবে না। সাক্কু বলেন, ৩ বছরে যানজট-জলাবদ্ধতা নিরসনকে অগ্রাধিকার, নতুন কর ও হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি না করাসহ কৃষি-প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, সঙ্গীত কলেজ, মাতৃভাষা কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করার লক্ষ্যে কাজ করছি। আমি নির্বাচনের আগে ২৭ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছি। ঘোষিত এ ইশতেহার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমি কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কাক্সিক্ষত বরাদ্দ পাচ্ছি না। চরম বৈষম্যের মাঝে আমি প্রাচীন এ নগরের জনগণকে সেবা প্রদান করে আসছি। মেয়র সাক্কু আরও বলেন, কুমিল্লা নগরীর অধিকাংশ নাগরিক সঠিকভাবে হোল্ডিং ট্যাক্স দেয় না। নগরীর ৭০ ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করে না এবং ব্যবসায়িক ট্যাক্স পরিশোধ করে না। সম্প্রতি আমরা বৈঠক করে এসব ট্যাক্স আদায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। পরিকল্পিত নগরায়ণে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও নগর আইন বাস্তবায়ন করতে হলে সরকার এবং নগরবাসীর একান্ত সহযোগিতা লাগবে। অন্যথায় নগরের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
সূত্রঃ যুগান্তর