কুমিল্লার আলোকিত মুখ সব ক্রিকেটারের ‘মতি ভাই’

ডেস্ক রিপোর্টঃ ‘ক্রিকেট’- নিছকই একটা খেলা। জাগতিক জীবনে বিনোদনের আরেকটা উৎসও বলতে পারেন। তবে কারো কারো কাছে ২২ গজের লড়াই, সবুজ গালিচা হয়ে ওঠে জীবনের প্রতিবিম্ব। আব্দুল মতিন তেমন ঘরনারই মানুষ। মাঠের টান, কর্মনিষ্ঠার কারণে প্রিয়জনের অন্তিম বাণীও শোনার ফুরসত মেলেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) বর্ষীয়ান এই হেড গ্রাউন্ডসম্যানের। কুমিল্লার দেবিদ্বারে জন্ম মতি ভাইয়ের।

বুধবার বিসিবির একাডেমি ভবনে সাথে একান্ত আলাপের সময় হৃদয় বিদীর্ণ করা সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে অশ্রুসজল হলেন মতিন। কর্তব্যপরায়ণতার কারণে ২০০৬ সালে স্ত্রীর মৃত্যুর সময় তার সাথে একটা কথা বলতে পারেননি। তবুও খেদ নেই প্রবীণ এই মাঠ কর্মীর। এই মাঠই তার পরিবার, মাঠই তার প্রেম।

বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘এই ক্রিকেটের ডিউটির জন্য আমি আমার স্ত্রীর মৃত্যুর সময় তার সাথে একটা কথা বলতে পারিনি। আমার বাড়ি যাওয়ার কথা ছিলো বৃহস্পতিবার। মঙ্গলবার আমার স্ত্রী মারা যায়। আমি বলছিলাম যে, আমি বৃহস্পতিবার বাড়ি আসবো, ওইদিন আমি কুমিল্লা স্টেডিয়ামে কর্মরত ছিলাম। আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, তুমি ছুটি পাও না? আমি বলেছি আমি বৃহস্পতিবার আসি? বলেছে যে আসো। কিন্তু মঙ্গলবারই সে মারা যায়।’

১৯৭৮ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) চাকরি নেয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে তার পথচলা শুরু। দীর্ঘ এই পথচলায় কী পেলেন? এমন প্রশ্ন শুনেও চোখ ভিজে উঠলো বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কাছে ‘মতি ভাই’ হিসেবে পরিচিত আব্দুল মতিনের। আক্ষেপ, হতাশা বা না পাওয়ার বেদনা থেকে নয়, ক্রিকেট মাঠের আলোচনা উঠলেই আবেগী হয়ে পড়েন তিনি। চোখ ভিজে যায় তৃপ্তির জলে। ক্রিকেট মাঠ মানে তার কাছে ভালোবাসার জায়গা। সেটা না হলে ৪০ বছর (১৯৭৮-২০১৮) একটি জায়গাতে কাটিয়ে দিতে পারতেন না।

মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে প্রথম ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হয় ২০০৬ সালে। ওই ম্যাচের উইকেট তৈরি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান কিউরেটর রিচার্ড উইন্টার। তার সাথে কাজ করেছিলেন হেড গ্রাউন্ডসম্যানের দায়িত্বে থাকা মতিন। ১২ বছর পর শ্রীলঙ্কা-জিম্বাবুয়ে ম্যাচ দিয়ে সেঞ্চুরি পূর্ণ হয়েছে মিরপুর স্টেডিয়ামের। এমন ম্যাচের আগে মতিনকে স্মরণ করেছে বিসিবি। চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে দায়িত্বরত মতিনকে নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকায়।

টসের সময় ধারাভাষ্যকার, দুই দলের অধিনায়ক ও ম্যাচ রেফারির সঙ্গে আব্দুল মতিন (ডানে)

৫৮ বছর বয়সী এই গ্রাউন্ডসম্যানকে সম্মাননা দিয়েছে বিসিবি। টস করার সময় শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের অধিনায়কের পাশাপাশি রাখা হয় তাকেও। টিভি পর্দায় দেখানো হয় ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে থাকা এ প্রৌড়কে। যেখানে ধারাভাষ্যকার অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল পরিচয় করিয়ে দেন এই মাঠের প্রথম ওয়ানডের হেড গ্রাউন্ডসম্যান হিসেবে কাজ করা মতিনকে। অন্যসব গ্রাউন্ডসম্যানের মতো তাকেও পরিয়ে দেওয়া হয় এক’শ ওয়ানডে লেখা বিশেষ জ্যাকেট।

এমন স্বীকৃতি পেয়ে খুশিতে আত্মহারা মতিন, ‘আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া যে বিসিবি আমাকে ডেকেছে। আমাদের আসলে দেখানোর মতো কিছু নেই। আমাদের কাজটা মাটির সাথে। আজ ১০০তম ম্যাচ হয়েছে, এখানে আমি উপস্থিত আছি। এ কারণে আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া। যাদের উদ্যোগে বা যারা এনেছেন আমাকে, তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এটা আমার কাছে অনেক পাওয়া। আমি অনেক অনেক খুশি।’

তবে ঢাকায় আসার খবর শুনে ভড়কেই গিয়েছিলেন। এই বয়সে পোস্টিং হলো না তো? মতিন বলেন, ‘জাহিদ রেজা বাবু, উনি আমাকে বলেন, মতিন ভাই আপনি কোথায়। আমি বলেছি স্যার আমি সাগরিকায়। উনি বলেন আপনি আগামীকাল চলে যাবেন ঢাকা। এটা শুনে একটু ভীতু হয়ে গেছি যে পোস্টিং নাকি। এই বুড়ো বয়সে শীতের মধ্যে পোস্টিং দিলে কেমন হবে। উনি বলেছেন না, ওখানে ১০০তম ওডিআই ম্যাচ হবে, ম্যানেজার আপনাকে যেতে বলেছেন।’

২০০৯ সালে এনএসসির চাকরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে বিসিবিতে যোগ দেন হেড গ্রাউন্ডসম্যান হিসেবে। কিন্তু এত বছরেও হয়ে ওঠা হয়নি কিউরেটর। নামের পাশে অ্যাসিসট্যান্ট কিউরেটর থাকলেও আদতে সেটা বিশেষ কিছু নয়। শিক্ষাগত যোগ্যতাই তাকে কিউরেটর হতে দেয়নি। মতিন বলছেন, ‘এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ, বিসিবি চাচ্ছিলো আমাকে কিউরেটর বানাতে। আমার মেধার কারণে আমি হতে পারিনি। আমার ওই মেধাটা (শিক্ষাগত যোগ্যতা) নেই। আমি যা আছি, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।’

এনএসসির চাকরি ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে প্রবীণ এই মাঠকর্মী বলেন, ‘ক্রিকেট মাঠটাকে আমি আমার পরিবারের মতো মনেকরি। সরকারি চাকরি করলে ২০২১ সালে আমার শেষ হতো। এটা আমার অনেক ভালো লাগতো বলে আমি এখানে চলে এসেছি। এ জায়গা আমার কাছে অনেক ভালো লাগে। তবে আমি নিজেও জানি না ক্রিকেট মাঠটাকে আমার কেন এত ভালো লাগে। আমার আরো অফার ছিল। দুই দুইবার বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তখন বিসিবি আমাকে ছাড়েনি।’

সূত্রঃ প্রিয় ডট কম

আরো পড়ুন