কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী রসমালাই, নকলের ভিড়ে আসল চেনা দায়

ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লার রসমালাই। স্বাদ, গুণ, ঐতিহ্যের কারণে রসমালাইয়ের বিশ্বজোড়া খ্যাতি। কুমিল্লার বিখ্যাত যে ক’টি জিনিস রয়েছে এর মধ্যে রসমালাই অন্যতম। কেউ কুমিল্লায় গিয়েছেন আর রসমালাই খাননি এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। দেশি বিদেশি হাজারো পর্যটক কুমিল্লায় গেলে সবাইকে আতিথেয়তা করা হয় এই রসমালাই দিয়ে। দেশ বিদেশের কূটনীতিকরা গেলেও রসমালাইয়ের জন্য মাতৃভাণ্ডারে যেতে ভুল করেন না কেউ।

প্রতিদিন কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় মনোহরপুরে মাতৃভাণ্ডার, ভগবতী, কান্দিপাড়ে জেনিস, জলযোগ আর জিলাস্কুল রোডে পোড়াবাড়ি মিষ্টির দোকানে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিক্রি হয় রসমালাই ও মিষ্টান্ন জাতীয় পণ্য। রসমালাইয়ের জন্য বিখ্যাত মাতৃভাণ্ডারে ক্রেতাদের রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কোনো কোনো সময় ক্রেতাদের লাইন দোকান থেকে রাস্তা পর্যন্ত এসে শেষ হয়।

তবে কোনো ক্রেতাই ৫ কেজির বেশি কিনতে পারেন না। এখানে প্রতিদিন কেজিপ্রতি ২৬০ টাকা দরে প্রায় লাখখানেক টাকার রসমালায় বিক্রি হয়। যদিও মাতৃভাণ্ডারের কেউ বলতে রাজি নন, এখানে কত পরিমাণ রসমালায় উৎপাদন এবং বিক্রি করা হয়।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের প্রথম দিকে ত্রিপুরা রাজ্য তথা কুমিল্লার ঘোষ সম্প্রদায় দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর বানিয়ে তাতে ছোট আকারের শুকনো ‘ভোগ’ বা রসগোল্লা ভিজিয়ে যে মিষ্টান্ন তৈরি করে, তা ক্ষীরভোগ নামে পরিচিতি পায়। ক্রমান্বয়ে এই ক্ষীরভোগ রসমালাই নামে পরিচিত হয়ে উঠে। ১৯৩০ সালে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরে মাতৃভাণ্ডার নামের দোকানে বিখ্যাত এই রসমালাই বিক্রি শুরু হয়। খনিদ্র সেন ও মণিদ্র সেন নামের দুই ভাই রসমালাই তৈরি করে বিক্রি শুরু করেন। খুব অল্প দিনের মধ্যে রসমালাইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। বর্তমানে এ মাতৃভাণ্ডার পরিচালনা করেন শংকর সেন। জানা যায়, ১৯৯৮ সালের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে জেলা পরিক্রমা অনুষ্ঠানে কুমিল্লার অন্যান্য ঐতিহ্য দেখানোর পাশাপাশি মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইও দেখানো হয়। এরপর সারা দেশে রসমালাইয়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। কিন্তু এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে প্রতারণা করছে একটি ব্যবসায়ী চক্র।

যার ফলে কুমিল্লার বাইরে থেকে গিয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হচ্ছেন কুমিল্লার রসমালাইয় ও এর স্বাদ নিয়ে। জানাশোনার অভাবে এবং বাইরের চাকচিক্য দেখে অনেকেই প্রতারিত হচ্ছেন রসমালাই কিনে। কুমিল্লা শহরের রেল স্টেশন, গুরুত্বপূর্ণ বাসস্ট্যান্ড, আলেখারচর বিশ্বরোড, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, হাইওয়ে রোডের বড় বড় হোটেলগুলোসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার ৯৭ কিলোমিটার রাস্তার আশেপাশে গড়ে উঠছে অর্ধশতাধিক নকল শো-রুম। বিশেষ করে মহাসড়কের পাশে ঐতিহ্যবাহী মাতৃভাণ্ডারের নামের সামনে ‘কুমিল্লা’, ‘কুমিল্লার’, ‘আদি’, ‘খাঁটি’, ‘মা’, ‘নিউ মেসার্স’ ইত্যাদি নাম ছোট করে ব্যবহার করে মাতৃভাণ্ডার শব্দটি বড় করে ব্যবহার করে আকৃষ্ট করছে ক্রেতাদের। আবার ক্রেতাদের আরো বেশি আকৃষ্ট করতে ‘আমাদের একমাত্র শো-রুম’ শব্দটিও ব্যবহার করছেন তারা। এতে ক্রেতারাও আকৃষ্ট হচ্ছে বেশ।

কথা হয় এমন একজন ক্রেতার সঙ্গে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে যাত্রাবিরতি করেন আনোয়ার সাঈদ। তিনি মহাসড়কের পাশে কুমিল্লা মাতৃভাণ্ডার থেকে ২ কেজি রসমালাই কিনেছেন বাড়ি নেয়ার জন্য। এ রসমালাই নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের কথা তো সারা বিশ্ব জানে। আমি জানবো না কেন। এই জন্য তো এখান থেকে নিলাম। পরে যখন তিনি জানতে পারেন, এই মাতৃভাণ্ডার আসল কোনো মাতৃভাণ্ডার না, তারা তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, তখন তিনি হতাশ হন।

এমনভাবে ক্রেতারা প্রতিনিয়ত ঠকছেন। ক্রেতারা মনে করছেন মহাসড়কের পাশে এসব দোকানই আসল দোকান। ঢাকার বাইরে যাওয়ার পথে এসব রসমালাই কিনে নিয়ে যাচ্ছে ক্রেতারা।

কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী মাতৃভাণ্ডারের কর্ণধার অনির্বাণ সেন গুপ্ত বলেন, আমরা কারো বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে পারছি না। কারণ তারা প্রত্যক্ষভাবে মাতৃভাণ্ডার শব্দটি ব্যবহার করছে না, চালাকি করে নিউ, আদি একমাত্র, শুধুমাত্র শব্দগুলো ব্যবহার করছেন। এতে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী রসমালাই কিনতে এসে প্রতারণার শিকার হচ্ছে ক্রেতারা। শুধু তাই নয়, আমাদের স্বাদ আর নকল মাতৃভাণ্ডারের স্বাদ আকাশপাতাল তফাৎ। এতে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী রসমালাইয়ের বদনাম হচ্ছে।

সূত্রঃ মানবজমিন

আরো পড়ুন