কুমিল্লার হাজি বারেক, এক কোটিপতি প্রতারকের গল্প

ডেস্ক রিপোর্টঃ সৌদি আরব থেকে প্রতারণার কৌশল রপ্ত করে দেশে ফিরে ৪৩ বছর ধরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন বারেক সরকার ওরফে হাজি বারেক (৬৩)। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা বারেকের এখন রাজধানী ঢাকায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট, বিলাসবহুল গাড়ি এবং গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় বিস্তর জমিজমা। প্রতারণার এক বিস্তৃত ও অভিনব সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন তিনি। এই চক্রের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে তারই দুই ছেলে ও এক ভাগিনা। চক্রটি নিজেদের সদস্যদের নিয়ে গড়ে তুলেছে আরসিডি (রয়েল চিটার ডেভেলপমেন্ট) নামে একটি সংগঠন। যে সংগঠনের প্রতিটি গ্রুপ ৫টি স্তরে ভাগ হয়ে কাজ করে। কিন্তু প্রতিটি গ্রুপেরই নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন বারেক। র‌্যাবের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই চক্রের প্রতারণার অভিনব সব কৌশল।

গত ২৫ মে রাজধানীর দারুসসালাম এলাকা থেকে চার সহযোগীসহ বারেক সরকারকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এরও আগে গত ১ মার্চ তার চক্রের আরও ২২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। বারেকের বিরুদ্ধে দারুসসালাম থানায় দুটি মামলা হয়েছে। এখন তার বিপুল সম্পদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, প্রতারক চক্র আরসিডির সদস্যরা সাধারণত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন এলাকার তাঁত ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে থাকে। এ ছাড়া আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদের জমি বা নির্মাণাধীন ভবনের ওপর ইন্টারনেট টাওয়ার স্থাপন এবং বাসা-বাড়িতে বিনা খরচে সোলার প্যানেল বসানোর কথা বলেও তারা প্রতারণা করে থাকে।

র‌্যাবের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম সজল বলেন, ‘চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। চক্রের মূল হোতা বারেক সরকারকে অনেক চেষ্টার পর গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। তিনি সৌদি আরব থেকে প্রতারণার প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে গড়ে তোলেন প্রতারক সিন্ডিকেট। ৪৩ বছর ধরে তার খপ্পরে পড়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন। প্রতারণার মাধ্যমে বারেকের গড়ে তোলা বিপুল সম্পদের তথ্যও আমরা পেয়েছি।’

বারেকের বিরুদ্ধে দারুসসালাম থানায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শরিফুজ্জামান বলেন, ‘বারেক সরকারের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত শুরু করেছি। তদন্তের স্বার্থে এখনই বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো হবে।’

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, ১৯৫৬ সালে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার বাহেরচর গ্রামে জন্ম বারেকের। শিক্ষাজীবনে প্রাথমিকের গন্ডি পার হতে পারেননি তিনি। পরে ১৮ বছর বয়সে তাকে সৌদি আরবে পাঠিয়ে দেন বাবা-মা। কিন্তু সেখানে গিয়েও তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারেননি বারেক। তবে সেখান থেকে প্রতারণার নতুন নতুন কৌশল রপ্ত করে মাত্র দুই বছরের প্রবাসজীবন শেষে দেশে ফেরেন তিনি। দেশে ফিরে সুনির্দিষ্ট কোনো পেশায় না জড়িয়ে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আয়ের পথ বেছে নেন বারেক। প্রতারণার কাজে দক্ষতা ও সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা অল্পদিনের মধ্যে তাকে বড় সাফল্য এনে দেয়। দিনে দিনে তার প্রতারণার সাম্রাজ্যের পরিধি ও কৌশল বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে প্রতারণার সংগঠন আরসিডি গড়ে তোলেন তিনি। এই চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আলাদা গ্রুপ তৈরি করে অফিস ভাড়া নিয়ে নানা কৌশলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিল। নিজের দুই সন্তান মেহেদী হাসান হাবিব, আল-আমিন সরকার রাজ ও ভাগিনা শাহাদাৎ হোসেন বারেকের প্রতারণা চক্রের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করত।

র‌্যাব কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলাম সজল জানান, এই চক্রের প্রত্যেক সদস্য প্রতারণাকে তাদের পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। তারা প্রথমে নিজেদের বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে। এক একটি গ্রুপে সাধারণত ৫টি স্তরে সদস্য থাকে। তবে প্রতিটি গ্রুপের প্রধান বারেক সরকার। তিনি নিজেকে ‘বস’ পরিচয় দিয়ে প্রতারণা চক্রের প্রধান চরিত্রে থাকেন। বারেক নিজেকে সাধারণত বিদেশি নাগরিক পরিচয় দিয়ে ওই দেশের খ্যাতনামা কোনো কোম্পানি বা গ্রুপের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতেন। চক্রের সদস্যরা সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের অবসরের আগে থেকেই টার্গেট করে। টার্গেট ব্যক্তিদের নিজেদের কথিত কোম্পানিতে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে অফিসে নিয়ে আসত প্রতারক চক্রের সদস্যরা। টার্গেট ব্যক্তিরা অবসরের টাকা পাওয়ার পরপরই প্রতারক চক্রের একটি বিশেষায়িত দল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের কথিত কোম্পানিতে উচ্চ বেতনে চাকরিতে নিয়োগ দেয়। দামি গাড়িতে অফিসে আনা-নেওয়ার একপর্যায়ে ওই প্রতিষ্ঠান বা সহযোগী কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে তারা। পরে কথিত অফিসের কর্মকর্তাদের চালচলন ও ব্যবহারে অভিভূত হয়ে টার্গেট ব্যক্তিরা তাদের অবসরকালীন প্রাপ্ত সব টাকা কথিত ওই অফিসে বিনিয়োগ করেন। আর এই বিনিয়োগের কয়েক দিনের মধ্যেই ওই অফিস এবং অফিসের কর্মকর্তারা হাওয়া হয়ে যায়।

আরো পড়ুন