কুমিল্লায় বাড়ছে পারিবারিক কলহে আত্মহনন

ডেস্ক রিপোর্টঃ চলতি বছরের ১১ জুন। দুই পৃষ্ঠার চিরকুটে ‘অপ্রাপ্তি-হতাশার’ অগোছালো বর্ণনা দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর আবদুল ওহাব।

ঈদের চার দিন আগে ২৫ রমজানের সেহরি শেষে ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই নিজের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেন প্রবীণ এই শিক্ষক। সকালে নগরীর মহিলা কলেজ রোডে অবস্থিত বাসা থেকে তাঁর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

৩ সেপ্টেম্বর। কুমিল্লার চান্দিনায় ‘মৃত্যুর জন্য পুরো পরিবারকে দায়ী’ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেন উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাশার মাহমুদ। তিনি চান্দিনা পৌর এলাকার কচুয়ারপাড়ের ব্যবসায়ী আবদুল জব্বারের ছেলে। পরদিন মঙ্গলবার ঘরের সিলিং থেকে উদ্ধার করা হয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের এ শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত লাশ।

চার মাসের ব্যবধানে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া শিক্ষক-ছাত্রের ‘সুইসাইড নোট’ ঘেঁটে এবং তাঁদের সহকর্মী-সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে দুজনই ছিলেন বিমর্ষ-হতাশাগ্রস্ত। অতঃপর বুকের ভেতর জমে থাকা পারিবারিক ‘ক্লেদ’ উঠে আসে চিরকুটে- ‘… বিদায়, আল বিদা। কি লিখছি জানি না। মনের কথাগুলো লিখতে পারলাম না। সময় নেই। দেরি হয়ে যাচ্ছে…’ অথবা ‘… যদি আমার মৃত্যু হয়, তার দায় পুরো ফ্যামিলির- বিশেষ করে আমার ভাইয়ের…।’

অধ্যক্ষ আবদুল ওহাব কিংবা ছাত্রলীগ নেতা বাশার মাহমুদই নন, গত পাঁচ মাসে শুধুমাত্র পারিবারিক কলহে কুমিল্লায় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। সব মিলিয়ে জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এ তালিকাটি ১৬০ জনের। সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর কুমিল্লার তিতাসে নিজ কক্ষে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন বোরহান আহমেদ সুমন নামে এক স্কুল শিক্ষক। উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকা আত্মহত্যার এ প্রবণতায় শঙ্কিত কুমিল্লার নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। তাদের অনেকের ভাষ্য, ‘অস্থির এ সময় কলহ-দণ্ড-বিতণ্ডায় একজন অধ্যক্ষকেই যদি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয় তবে এ ‘মিছিলে’ নারী-শিশুসহ সাধারণের তালিকা দীর্ঘ হওয়ার শঙ্কা তো থেকেই যায়।’

শঙ্কার বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ জামাল নাছের। তিনি বলেন, ‘আবদুল ওহাব সহজ-সরল ও ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তাঁর এমন মৃত্যু অচিন্তনীয়। আলোর পথ দেখানো মানুষরাই যদি আত্মহননে ‘মুক্তি’ খোঁজেন, বিষয়টি তখন পরিবার-সমাজের জন্য শঙ্কা-জাগানিয়া হয়ে ওঠে।’ জামাল নাছের বলেন, ‘লেখাপড়া ও চাকরির কারণে আবদুল ওহাব দীর্ঘদিন গ্রাম ও স্বজনদের কাছ থেকে দূরে ছিলেন। ফলে স্ত্রী-সন্তান ছাড়া পরিবারের বাকিদের সঙ্গে গড়ে ওঠা দূরত্বটি আর গুছিয়ে ওঠেনি।’

কুমেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গত পাঁচ মাসে কুমিল্লার ১৭টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আত্মহত্যা করেছেন ১৬০ জন। ভিকটিম পরীক্ষার রেজিস্ট্রার্ড বইয়ে এ সংখ্যাটি উল্লেখ থাকলেও প্রকৃত সংখ্যাটি অবশ্য অজানাই রয়েছে। কারণ, এদের অনেককেই সংশ্লিষ্ট থানা থেকে ‘অনাপত্তি’ নিয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়। আর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, পাঁচ মাসে দেড় শতাধিক ‘স্বেচ্ছামৃত্যুর’ মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই ঘটেছে পারিবারিক কলহ, বাগবিতণ্ডা কিংবা অপমান-অভিমানে। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু-কিশোর।

একদিনেই পাঁচজনের প্রাণহানি:
গত ১০ অক্টোবর বুধবার কুমিল্লার লাকসামে স্ত্রীকে হত্যার পর ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন স্বামী শফিউল্লাহ। স্ত্রী রাবেয়া বেগমের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা কলহ ও সম্পর্কের টানাপড়েনের জের ধরেই এ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি পড়শি ও এলাকাবাসীর।

বিষয়টির সঙ্গে একমত লাকসাম থানার ওসি মনোজ কুমার দে। তিনি বলেন, আত্মহত্যাকারীর স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা জানতে পেরেছি- দীর্ঘদিন ধরেই এ দম্পতির মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। এ নিয়ে ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকতো।’

একই দিনে কুমিল্লার বরুড়া ও চৌদ্দগ্রামে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে দুই কিশোরসহ তিনজন। এ তিনটি প্রাণহানিও পারিবারিক কলহ এবং মান-অভিমানের জের ধরে ঘটেছে বলে নিশ্চিত করেছে তাদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা।

এ ছাড়া গত ৩০ আগস্ট দেবীদ্বারে স্বামীর সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা করেন গৃহবধূ সুমি আক্তার (২২)। তার আগে ৬ জুন ব্রাহ্মণপাড়ায় গৃহশিক্ষকের ‘বেত্রাঘাতের অপমানে’ আত্মহত্যা করে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রী। দাউদকান্দিতে শ্বশুরালয় থেকে উদ্ধার করা হয় গৃহবধূর লাশ। ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণপাড়ায় আত্মহত্যা করে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী। পরদিন একই উপজেলায় ‘নামাজের ছুটির ফাঁকে’ শ্রেণিকক্ষে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। ২৬ সেপ্টেম্বর আত্মহত্যা করে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্র।

এ ছাড়া ৫ অক্টোবর কুমিল্লার তিতাসে বিয়ের ১৫ দিন পর পিত্রালয়ে ফিরে আত্মহত্যা করে এক কিশোরী নববধূ (১৫)। জানা গেছে, প্রবাসী ও বয়স্ক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ায় আত্মহননের পথ বেছে নেয় সে। ২৭ সেপ্টেম্বর নাঙ্গলকোটে পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে না দেওয়াকে কেন্দ্র করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডের পর আত্মহত্যা করেন এক তরুণী (১৯)। ৯ অক্টোবর দেবীদ্বার ও ব্রাহ্মণপাড়ায় আত্মহত্যা করেন দুই গৃহবধূ।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা আত্মহত্যার প্রবণতা রুখতে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধন আরো দৃঢ় করার আহ্বান জানিয়েছেন কুমিল্লার বিশিষ্টজনরা। তাঁরা বলেন, দূরত্ব বাড়লেই বাড়লে নিঃসঙ্গতা। একাকিত্ব তখন কুড়ে-কুড়ে খায়, বিপথগামিতা বাড়ায়।

এ বিষয়ে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট শিশু সংগঠক ডা. ইকবাল আনোয়ার বলেন, আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়; তারপরও হতাশা-বিষাদগ্রস্ততা থেকে অনেকেই এ পথে পা বাড়ায়। আত্মহত্যা এখন ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে কুমিল্লায় এখন ‘সুইসাইডাল ক্লাস্টার চলছে’। একজনের দেখাদেখি অন্যজনের সংক্রমণের মতো আত্মহত্যার প্রচণতা বাড়ছে। তা প্রতিরোধে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

ডা. ইকবাল আরো বলেন, হতাশাগ্রস্তদের বুঝাতে হবে- জীবনে দুঃখ-বেদনা থাকবে, ব্যর্থতা-অপূর্ণতা থাকবে; তারপরও নতুন উদ্যমে আগামীর লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। দীর্ঘ ব্যর্থতার পর প্রাপ্ত সফলতাতেই আনন্দ বেশি- এর মাঝেই লুকিয়ে থাকে জীবনের চরমতম রোমাঞ্চ।

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ

আরো পড়ুন