স্মৃতির মানসপটে আজও অক্ষত শহীদ আহাদ-মিজান

মোঃ দলিলুর রহমান-মানিকঃ ২৯ জুলাই, একটা সময় পর্যন্ত এই বিশেষ দিনটি নিয়ে আমি অনেক ব্যস্ত থাকতাম। কিন্তু এখন আর সে ভাবে ব্যস্ত থাকতে হয় না। একজন সাবেক উপজেলা ছাত্রলীগের সদস্য সচিব ও সভাপতি হিসেবে এই দিনটিতে উপজেলা ছাত্রলীগ আয়োজিত অনুষ্টানে দাওয়াত পাওয়াটাও বর্তমানে আমার ভাগ্যের বিষয়।

মৃত বাড়িতে কত মানুষ কে খাবার খেতে দেখেছি। পরিবারের একজন মারা গেছে বাকীরা সবাই কান্নাকাটি করে ক্ষুধার্ত হয়ে পাশের ঘরে বসে খাবার খাচ্ছে। জীবনের প্রয়োজনেই স্বজনের লাশের পাশে বসে খাবার খেতে ও মানুষ কুন্ঠিত হয় না। মৃত্যু যেমন কাউকে ছাড় দেয়না, জীবন ও কাউকে ছাড় দেয়না, জীবন বড়ই নির্মম ও নিষ্ঠুর। এই জীবনের তাগিদেই আমাদের এই অবিরাম ছুটে চলা আর ভুলে যাওয়া নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া ভাল মন্দ সব কিছু। আহাদ মিজান হত্যাকান্ডের বিশ বছর পূর্ণ হল। বিশ বছর খুব কম সময় নয় এই সময়ে একটি শিশু ভুমিষ্ট হয়ে যৌবনে পর্দাপণ করে, আর বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার হিসাবে এই বয়সের একটি তরুন প্রাথমিক আর মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায় কলেজে ভর্তি হয়। একই আশায় নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজে এসেছিল এক দরিদ্র স্কুল শিক্ষক আরেক দরিদ্র কৃষকের সন্তান আব্দুল আহাদ ও মিজানুর রহমান। কি আশা করেছিল এই দরিদ্র দুই তরুন এই জাতির কাছে, এই সমাজের কাছে একটু উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অল্পসল্প বেতনে একটি চাকুরী যোগাড় করে নিজেদের অবস্থার একটু পরিবর্তন, দরিদ্র বাবাকে একটু সাহায্য করা এর চাইতে বেশি কিছু তো নয়। কিন্তু তাদের সেই পবিত্র যাত্রাকে চীরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছিল ইসলামের নামধারী হিং¯্র হায়েনার দল জামাত শিবিরের সন্ত্রাসীরা, তাদের ধারালো অস্ত্রের নির্মম আঘাতে শহীদ হল এই দুই তরুণ। একই সাথে তছনছ হয়ে গেল দুটি পরিবারের স্বপ্ন, দুটি পরিবারের অবলম্বন। ছাত্রলীগের এই দুই তরুন নেতার হত্যাকান্ডে স্তব্ধ হয়ে গেল শান্তিপ্রিয় গোটা লাকসামবাসী। মানুষ শোককে শক্তিতে পরিণত করে প্রতিবাদি হয়ে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে খুনির দলের বিরুদ্ধে। জনতার এই প্রতিরোধ সেদিন অবশ্যই যুক্তিসংগত ছিল। শান্তির এই জনপদে এই ধরনের হত্যকান্ড মানুষ মেনে নিতে চায়নি। কারন সেদিনের ক্লাস পরবর্তী এই ছাত্র সমাবেশে উপস্থিত এক দেড়শ ছাত্রের যে কেউই এই হত্যাকান্ডের শিকার হতে পারতো।। ছেলে কলেজ থেকে বাড়ি ফিরবে, মা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন, যেমন অপেক্ষা করেছেন মিজানের মা আর আহাদের স্বজনেরা যতটুকু জানতাম আহাদের মা ছিলনা। অন্যরা মায়ের কোলে ফিরে যেতে পারলেও আহাদ আর মিজান চলে গেল না ফেরার দেশে। মিজানের মায়ের আর আহাদের স্বজনদের অপেক্ষার প্রহর এই জনমে আর শেষ হবেনা। তারা আর কোন দিন ফিরে আসবে না। এই রকমের একটি মানবিক উপলব্ধি থেকেই সেদিন লাকসামের মাটি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তৎকালীন লাকসামের আওয়ামীলীগ নেতাদের রাজনৈতিক উদারতায়, বিশেষ করে মো: তাজুল ইসলাম এমপির আইন নিজ হাতে তুলে না নেওয়ার আহবানে মানুষ সাড়া দিলে বড় ধরনের রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হয়। আমরা সেদিন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েছি। আমাদের নেতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছি। কিন্তু বিশ বছরেও এই হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি। কবে হবে তাও আমরা জানিনা। বিশ বছর পরেও এই হত্যাকান্ডের বিচারের জন্য মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা-শোকসভা করতে হয়, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে। এই হত্যাকান্ড যখন সংঘটিত হয় তখন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল, এর পর আবার পুনরায় আওয়ামী লীগ দশ বছর ক্ষমতায় আছে। দল ক্ষমতায় না থাকলে ভেবে নিতাম যে সরকার এই বিচারের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এখন তো সেটা ভাবার সুযোগ নেই। তাহলে এই বিচার হবেনা কেন? সভ্য সমাজে হত্যা তো নয়ই যে কোন গুরুতর অপরাধের বিচার চাইতে হয়না। বাংলাদেশকে যদি আমরা সভ্য দেশ বলে দাবি করি তাহলে একটি খুনের বিচার চাইতে হবে কেন। প্রকাশ্য দিবালোকে দুটি নিষ্পাপ ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করা হল। এরপর বিশটি বছর অতিবাহিত হল, আমরা অনেকেই অনেক পদ পেলাম, নেতা হলাম। আর এই দুটি ছেলের পরিবারের কি তাদের স্বজন হত্যার বিচার পাওয়ার অধিকার নেই? এই হত্যাকান্ডের বিচারের পথে যদি দলীয় কোন আইনজীবি অথবা রাজনৈতিক নেতা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, তবে সময়ের ব্যবধানে অবশ্যই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। শহীদ আহাদ-মিজানের আত্মা কখনো আপনাদের ক্ষমা করবেনা।

মহান আল্লাহ্ কাছে আমাদের ফরিয়াদ আব্দুল আহাদ এবং মিজানুর রহমানকে জান্নাতবাসী করুক, আমীন…!

আরো পড়ুন