হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাকে চাকরি দিতে যাচ্ছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) মার্কেটিং বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও কাজী নজরুল ইসলাম হল শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ সাইফুল্লাহকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত রেজাউল ইসলাম মাজেদ আসামিকে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিতে যাচ্ছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

২০১৯ সালে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে প্রায় তিন বছর বোর্ড (আবেদনকারীদের পরীক্ষা নেয়ার আয়োজন) গঠন করা না হলেও ওই অভিযুক্তকে নিয়োগ দিতে প্রশাসন উঠে পড়ে লেগেছে বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্টরা। আগামী ২৭ অক্টোবর এ বোর্ড আয়োজন হওয়ার কথা রয়েছে।

রেজাউল ইসলাম মাজেদ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত করে নিজেদের মদদপুষ্ট লোকেদেরকে নতুন কমিটিতে আনতে তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছেন। সেজন্য সাধারণ সম্পাদককে চাকরি দিতেও মরিয়া হয়ে পড়েছেন তারা।

এর আগেও একই হত্যা মামলায় অভিযুক্ত একাধিক আসামিকে প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের শেষ দিকে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগের জন্য আবেদন চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরীর প্রশাসন। করোনার কারণে বোর্ড পিছিয়ে গেলে ২০২১ সালের মাঝামাঝি এসে পুনরায় একই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর এক বছরেরও অধিক সময় পেরিয়ে গেছে, তবে বোর্ড আয়োজন করেনি কর্তৃপক্ষ। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় শূন্য পদের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেও এ ব্যাপারে নীরব ছিল তারা। এমনকি চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের যোগদানের পরে তাকেও বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে জানানো হয়েছিল। আবদুল মঈন যোগদানের পর এ ব্যাপারে আট মাস নীরব থাকলেও নির্দিষ্ট প্রার্থী ও হত্যা মামলার আসামি রেজাউল ইসলাম মাজেদকে নিয়োগ দিতে চলতি মাসে বোর্ড গঠনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

এর আগে গত ৩১ মার্চ দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে রেজাউল ইসলাম মাজেদ আরো কয়েকজন নেতাকর্মীসহ নিজেদের নিয়োগ ও বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডারের দাবিতে ভিসির গাড়ি অবরোধ করে রাখেন। একই ঘটনায় উপস্থিত ছিলেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতিও।

২০১৬ সালের ১ আগস্ট ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী খালেদ সাইফুল্লাহ। ওই হত্যা মামলার চার্জশিটে তিন নম্বর আসামি হিসেবে তালিকায় নাম উল্লেখ রয়েছে রেজাউল ইসলাম মাজেদের। এ মামলায় ৫৫ দিন জেলও খেটেছেন তিনি। আদালতে বিচারাধীন ওই মামলার এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।

এ বিষয়ে আসামি রেজাউল ইসলাম মাজেদ বলেন, তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে নেয়া হয়েছিল। তিনি এ ঘটনায় নিরপরাধ।

তবে পুলিশের চার্জশিটে তার নাম থাকার কথা বলা হলে তিনি বলেন, তুমি কি আমাকে হত্যা মামলার আসামি মনে করতেছ। ওই ঘটনার তো এখনো চার্জশিট (চূড়ান্ত) গঠন করা হয় নাই।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শুরুতে মামলাটি তদন্ত করে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তবে বাদির নারাজি আবেদনের পর তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। আরেকবার নারাজির পর মামলাটি তদন্তভার যায় সিআইডি’র হাতে। সংস্থাটির চার্জশিটেও নারাজি দেয়ার পর গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে পুনরায় তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় পিবিআইকে। তাদের চূড়ান্ত চার্জশিট এখনো আদালতে জমা দেয়া হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের এক জ্যেষ্ঠ নেতা জানান, চাকরি পাওয়ার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে মাজেদ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রশাসনের পক্ষ নিয়েছেন। প্রশাসনের এক কর্তা তাকে সরাসরি চাকরির নিশ্চয়তা দিয়েছেন। কারণ, তারা চাচ্ছেন ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে নিজেদের মদদপুষ্ট লোক আসুক। সাধারণ সম্পাদকের চাকরি হয়ে গেলে কেন্দ্রের কাছে কমিটির মূল্য থাকবে না। তখন কেন্দ্র স্বপ্রণোদিত হয়ে কমিটি ভেঙ্গে দেবে।

শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, এটা (সাধারণ সম্পাদকের চাকরি) মূলত কমিটির ওয়েট নষ্ট করার জন্য। শাখা ছাত্রলীগের কাউকে চাকরি দেয়ার জন্য আমি প্রশাসনকে বলিনি। তবে প্রশাসনের ব্যক্তিগত পছন্দ থাকতে পারে।

ইলিয়াস আরো বলেন, খালেদ সাইফুল্লাহ আমার কর্মী ছিলেন। তার হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু অপরাধীরা অনেক ক্ষমতাশালী। এটার সাথে জড়িত কেউ অনৈতিক সুবিধা পাবে তা আমি চাই না।

এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: শামিমুল ইসলাম বলেন, আমি যতদূর জানি এই সার্কুলারটা অনেক দিন আগের। তবে নির্দিষ্ট কাউকে টার্গেট করে চাকরি দেয়ার জন্য (বোর্ড) হলে বিষয়টা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত তো কাউকে আইনের ভাষায় দোষী বলা না গেলেও এ ধরনের অভিযুক্ত কাউকে চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে মামলার বিষয় বিবেচনায় রাখা বাঞ্ছনীয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক বলেন, মামলাটি এখনো বিচারাধীন রয়েছে। প্রশাসন যদি হত্যা মামলার অভিযুক্ত আসামিকে চাকরির দেয়ার জন্য যদি তোড়জোড় করে থাকে, তাহলে এটা দুঃখজনক। প্রশাসনের উচিৎ এসব বিষয়গুলোতে আরো দায়িত্বশীল হওয়া।

তবে সোর্সের (সংবাদের) নাম না বলায় এসব বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি ভিসি অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন। তিনি বলেন, আমিতো এ বিষয় দেখবো পরে। তোমাকে এই তথ্য কে দিয়েছে, সেটা বল।

প্রতিবেদক সোর্সের বিষয় জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করায় ভিসি কোনো উত্তর দিতে পারবেন না বলে তার কল কেটে দেন।

সূত্রঃ নয়াদিগন্ত

আরো পড়ুন