কুমিল্লায় সোনালী ধান গোলায় তুলতে ব্যস্ত কৃষক
ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লায় ফসলের মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে সোনালী ধানের আভা। বৈশাখের দখিণা বাতাসে দোল খেতে খেতে দেশের প্রধান এ খাদ্যশস্য হাসি ফুটিয়েছে কৃষকদের মুখে; বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের ব্যস্ততা। মাঠের বাম্পার ফলন এখন গোলায় তুলতে ব্যস্ত কুমিল্লার কৃষক কৃষাণীরা। যদিও বাজারে কিছুটা মন্দাভাব, তারপরও কষ্টে সৃজিত ফলন আনন্দ-চিত্তেই ঘরে তুলছেন তারা।
কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে ফসলের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে বোরোর বাম্পার ফলনের চিত্র। প্রকৃতি এ বছর দু’হাত ভরে দিয়েছে কৃষকদের। আবহাওয়া ছিলো অনুকূলে, ফলন হয়েছে প্রত্যাশার চেয়ে ভালো। পেকেছে মাঠের ধান- তাই ভোরের সূর্য ওঠার সাথে সাথেই শুরু হয় ব্যস্ততা। স্বর্ণ রঙে পাকা ধান কাটতে শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে কাস্তে হাতে মাঠে ছোটেন কৃষক। ধান কাটা আর আঁটি বাঁধা শেষে ভার করে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ির উঠোনে অথবা সুবিধাজনক স্থানে। সেখানে মাড়াইয়ের পর রোদে শুকিয়ে তোলা হবে গোলায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, কুমিল্লায় এ বছর বোরোর আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৪৫৭ হেক্টর জমিতে। যা ছিলো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৪ হাজার হেক্টর বেশি। তেমনিভাবে ফলনও ছাড়িয়ে গেছে লক্ষ্যমাত্রা। হেক্টর প্রতি ধান উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৪.৯ টন।
কুমিল্লা সদর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়াসহ বেশ কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি কৃষক পরিবারেই এখন নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধ। মাঠে মাঠে শুরু হয়েছে ধান কাটা উৎসব। বাড়িতে চলছে মাড়াইয়ের কাজ। আর এসব কাজে কৃষকদের পাশাপাশি ব্যস্ততা বেড়েছে কৃষাণীদেরও। শত ব্যস্ততার পরও ফলন ভালো হওয়ায় সকল ক্লান্তি ভুলে তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে খুশির ঝিলিক। এ চিত্র কেবল উপরোল্লিখিত এলাকাগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়। নতুন ধান গোলায় তোলার এ উৎসব-আয়োজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জেলার ১৭টি উপজেলার প্রতিটি কৃষকের ঘরে।
তবে কয়েকদিন আগে বয়ে যাওয়া দু’দফা কালবৈশাখি ঝড় পরিশ্রম বাড়িয়ে দিয়েছে কৃষকদের। অনেক স্থানেই ঝড়ে মাটির সাথে লেপ্টে গেছে ধান ক্ষেত। এসব ধান কেটে বাড়ি নেয়া কৃষকের জন্য একটু বেশিই বিড়ম্বনার।
কথা হয় বুড়িচং উপজেলার চড়ানল গ্রামের কৃষক মাহাবুবুর রহমানের সাথে। কিশোর বয়সী পুত্র আর দুইজন শ্রমিককে সাথে নিয়ে ট্রাকের মধ্যে ধানের আঁটি তুলছিলেন তিনি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাহাবুব জানালেন, ‘বোরো ধানের ফলন এ বছর ভালোই হয়েছে। তবে বাজারে দাম কিছুটা কমে গেছে, অপরদিকে বেড়েছে শ্রমিকের দাম।’
শুধু তাই নয়, মাহাবুবুর রহমানের মতে, ‘শ্রমিক খোঁজে পাওয়াটাই এখন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। আগে যেখানে তিন শ’ সাড়ে তিন শ’ টাকায় একজন শ্রমিক পাওয়া যেতো- সেখানে এখন ৫ শ’ টাকায় মিলছে না। তাই বাধ্য হয়েই নিজেকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়; সাথে নিয়ে এসেছি স্কুল পড়ুয়া পুত্রকেও।’
তার মতো আরো অনেক কৃষকের সাথে কথা বলেই জানা গেলো শ্রমিক সঙ্কটের কথা। ময়মনসিংহ, রংপুর কিংবা গাইবান্দাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে থেকে আসা এসব শ্রমিকের চাহিদা প্রতি বছরই ইরি-বোরো মৌসুমে বেড়ে যায়। ফলে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় কৃষক-কৃষাণীদের। তখন পরিবারের অল্পবয়সী সদস্যরাও এগিয়ে আসেন তাদের সহযোগিতা করতে।
কুমিল্লা সদর উপজেলার মহেষপুর ঈদগাহ সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়কের পাশে মাটি ফেলে উঁচু করে রাখা স্থানে ধান মাড়াইয়ে ব্যস্ত ময়মনসিংহ থেকে আসা চারজন শ্রমিক। মাড়াই করার মেশিনের দুই পাশে মাঠ থেকে কেটে আনা আঁটি বাঁধা ধানের স্তূপ। বস্তা বিছিয়ে রাস্তায় বসে এ কাজের তদারকি করছেন কৃষক আবদুল হামিদ। বাড়ির উঠুনে জায়গা কম- তাই মাড়াই এবং শুকানোর কাজটা এ ‘খল্লা’তেই করছেন বলে জানালেন তিনি।
তার মতে, ধানের বাজারদর আরেকটু বেশি হলেই প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যাওয়া বোরোর ফলনের ‘প্রাপ্তিটা’ হতো ‘কাঙ্খিত’।
তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগেও বাজারে প্রতিমন ধান বিক্রি হতো ৯শ থেকে ১ হাজার টাকায়। কিন্তু এখন ৬শ’ টাকার বেশি বিক্রি করা যাচ্ছে না।’ ফলে মাঠের ফলন দেখে যতোটা খুশি হয়েছিলেন, বাজারদরে ততোটাই নাখোশ আবদুল হামিদ।
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ-পরিচালক দিলীপ কুমার অধিকারী বলেন, ‘কুমিল্লায় কৃষকদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ প্রদান করেছেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা।’
তার মতে, ‘সরকারের তরফ থেকে প্রাপ্ত সকল প্রকার সহযোগীতা আর কৃষকদের পরিশ্রমের ফলেই এ বছর বরোর বাম্পার ফলন হয়েছে কুমিল্লায়।’
তবে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বিভিন্নজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ফসলের মাঠে বাম্পার ফলনের পরও একদিকে বাজারে ধানের মূল্য হ্রাস অপরদিকে শ্রমিকের মূল্যবৃদ্ধিতে কিছুটা হতাশাও বিরাজ করছে কুমিল্লার কৃষকদের মাঝে। তবে তাদের আশা, এখন না হোক- কিছুদিন পর হলেও বাড়বে ধানের দাম; অধিক ফলনের মতো লাভের অঙ্কটাও প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যাবে।
সূত্রঃ poriborton