কুমিল্লায় সাড়ে চার হাজার কৃষকের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা
খায়রুল আহসান মানিকঃ কুমিল্লায় সাড়ে চার হাজার কৃষকের নামে সার্টিফিকেট মামলার খড়গ ঝুলছে। কৃষি ঋণের টাকা শোধ করতে না পারায় এসব কৃষকের নামে ইতোমধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। জেলার ১৭টি উপজেলায় ছয়টি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা ঋণের ১২ কোটি ৪৮ লাখ ৭১ হাজার টাকা আদায়ে মোট ৪৫ হাজারটি সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করে।
বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের পক্ষ থেকে জেনারেল সার্টিফিকেট অফিসার আদালতে এই ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ব্যাংকওয়ারি খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও সার্টিফিকেট মামলার সংখ্যা হচ্ছে— সোনালী ব্যাংকের ৩০ লাখ ৯৩ হাজার টাকা আদায়ে মামলা ১১১টি। জনতা ব্যাংকের ২৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা আদায়ে মামলা ১২০টি। অগ্রণী ব্যাংকের ২৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা আদায়ে মামলা ২০৩টি। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১১ কোটি ৫২ লাখ ৯৬ হাজার টাকা আদায়ে মামলা ৪ হাজার ৩১টি।
রূপালী ব্যাংকের ২ লাখ ৩১ হাজার টাকা আদায়ে মামলা ২৩টি। কর্মসংস্থান ব্যাংক ১৫ লাখ ২৪ হাজার টাকা আদায়ে মামলা ১২টি এবং বিআরডিবি তাদের ৬১ হাজার টাকা আদায়ে ১২টি মামলা করেছে। বাংলাদেশ আওয়ামী কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আলহাজ ওমর ফারুক বলেন, ‘ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ রের্কড কৃষকদের। আইনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ আছে। এই কৃষকরা যখন ঋণ পরিশোধ করতে পারে না, তখন বুঝতে হবে এর পেছনে কোনও কারণ আছে। হালের গরু মরে যাওয়া, অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হওয়া, নিজে অথবা পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়া, বিফসলহানি, ফসলের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়া, গবাদি পশু ও ফসল চুরি হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ঋণ পরিশোধে অপারগ হয়। ঋণ গ্রহণের সময় অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের লোকদেরকে বাড়তি টাকা দিতে হয়। অথচ এদেশেই ক্ষমতাশালীরা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ করেন না। অনেকেই টাকা নিয়ে বিদেশ পালিয়ে যান।
ঋণের টাকা বিদেশি ব্যাংকে রাখেন। এসব কাজে এদের ব্যাংকের ও প্রভাবশালী লোকেরা তাদের সয়হতা করে থাকে। এসব ঘটনার নায়কদের ক’জনের বিচার হয়েছে? ক’জন টাকা ফেরত দিয়েছেন? কৃষক পালাবে না। অথচ কৃষকদের নেওয়া ৫/৭ হাজার টাকা পরিশোধের দেরি হলে কিংবা পরিশোধ করতে না পারলে, তাদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা হয় ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়।’ তিনি বলেন, ‘ঋণ আদায়ে এদের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মানবিক আচরণ করা উচিত।’ তিনি কৃষকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সার্টিফিকেট মামলাগুলো তুলে নিয়ে ঋণের সুদ মওকুফ ও ঋণ মওকুফের দাবি জানান। জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কুমিল্লা জেলার সাবেক আহ্বায়ক, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া বলেন, ‘কৃষকরা কৃষির মেরুদণ্ড। কিছু সংখ্যক লোক নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে তহবিল শুন্য করে ফেলছে। ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ, চার-পাঁচ হাজার টাকা ঋণ শোধ করতে না পারায় দরিদ্র কৃষকদের নামে সার্টিফিকেট মামলা হয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে। যা নিন্দনীয়।; তিনি কৃষকদের নামে সার্টিফিকেট মামলা তুলে নিয়ে ঋণ মওকুফ করে দেয়ার দাবি জানান।
কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামের সাকচি গ্রামের কৃষক অজি উল্লাহ বলেন, ‘সামান্য কৃষিঋণের টাকা পেতে দালাল ও ব্যাংকের লোকদের টাকা পয়সা দিতে হয়। সময়মতো কৃষি ঋণ পাওয়া যায় না বলে ঋণের টাকা অন্য খাতে খরচ হয়ে যায়। ঘরবাড়ির দলিল ব্যাংকে জমা রেখে নেওয়া ঋণ কৃষক নানা সমস্যার কারণে সময়মতো পরিশোধ করতে পারে না। এজন্য ব্যাংক সার্টিফিকেট মামলা করে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। হাতকড়া লাগিয়ে আদালতের টানা-হেচড়া করে। এভাবে কৃষকদের সম্মানহানী করা উচিত নয়। ঋণ গ্রহীতাকে সময় দিলে তারা অবশ্যই ঋণের টাকা পরিশোধ করবে।’ এজন্য তিনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে মানবিক হওয়ার আহ্বান জানান।
সোনালী ব্যাংক কুমিল্লা প্রিন্সিপাল অফিসের অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার শাহিদা খানম বলেন, ‘আমরা কৃষি/পল্লিঋণ খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাদ্ধকৃত অর্থই কৃষকের মধ্যে বিতরণ করে থাকি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুসারে ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করে থাকি।এ ব্যাপারে আমাদেরকে জেলা-উপজেলা প্রশাসন সহায়তা করে থাকেন। ঋণ আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলারের আলোকে ঋণগ্রহীতাদের মামলা নিষ্পতির ব্যবস্থা করি। এক্ষেত্রে আমরা মানবিক দিকটিও বিবেচনায় রাখি। আমরা চাই ঋণ নিয়ে কেউ যেন হেনস্থার শিকার না হন। ঋণগৃহীতাদের সঙ্গে ঋণদাতার সুসর্ম্পক রাখতে আমরা সচেষ্ট থাকি।’