কুমিল্লার পুরাতন গোমতী, সাত শতাধিক দখলদারের কবলে!
ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লার পুরাতন গোমতী নদীর দুই পাড়ের বিভিন্ন স্থানের ২৫৮.০২ একর জায়গা ৭২২ জন দখলদারের কবলে চলে গেছে। প্রায় আড়াই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীর অংশ দখল করে তারা বহুতল ভবনসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এছাড়া নদী তীরের ঝুলন্ত পায়খানার মানব বর্জ্য, বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ও শহরের ড্রেনের দূষিত পানি নদীর পানি বিষাক্ত করে তুলছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভুগছেন দুই পাড়ের অন্তত ২০ সহস্রাধিক মানুষ। প্রায় দেড়যুগ ধরে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না হওয়ায় দখলযজ্ঞে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে পুরাতন গোমতী। নদীর জায়গা দখলমুক্ত করে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে ঢাকার হাতিরঝিলের আদলে গড়ে তোলা গেলে এটি হতে পারে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন এলাকা। সরেজমিন ঘুরে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গোমতী নদী একসময় কুমিল্লা শহর ঘেঁষে প্রবাহিত হতো। তখন বর্ষাকালে গোমতীর পানি বৃদ্ধি পেলে বাঁধ ভেঙে শহর তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় শহরবাসীর মাঝে আতঙ্ক দেখা দিত। তাই আশির দশকে শহর রক্ষার জন্য এ নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। এরপর থেকে শহরের উত্তর প্রান্তের কাপ্তানবাজার হতে পূর্ব প্রান্তের শুভপুর-টিক্কারচর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার নদীর অংশ পুরাতন গোমতী নদী (মরা নদী) নামে পরিচিতি লাভ করে। তখন থেকে স্থানীয় প্রভাবশালীরা সুযোগ বুঝে পুরাতন গোমতী নদীর টিক্কারচর, শুভপুর, সুজানগর, গাংচর, মোগলটুলী, পুরাতন চৌধুরীপাড়া, চাঁনপুর, গয়ামবাগিচা, কাপ্তানবাজারসহ নদীর বিভিন্ন স্থানের দুই পাড় ও পানির অংশ অবৈধভাবে দখলে নিয়ে নির্মাণ করে বহুতল ভবন, আধাপাকা বাড়িঘর ও দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা। এতে পুরাতন গোমতীর দুই পাড়ে ঘনবসতি গড়ে উঠেছে এবং আঁকাবাঁকা বিস্তীর্ণ নদী সরু খালের আকার ধারণ করেছে। শুভপুর এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল, গাংচর এলাকার আবদুল মবিনসহ স্থানীয়রা জানান, ‘এই নদীর পানিতে কখনো ভাসে মরা গরু, মুরগি, কুকুর-বিড়ালসহ পশু-পাখি। ভাসতে দেখা যায় কচুরিপানা, আবর্জনা ও ফেনসিডিলসহ নেশাজাতীয় মাদকদ্রব্যের বোতল। এছাড়া শহরের ড্রেনের ময়লা পানি শোধন ছাড়াই সরাসরি গড়িয়ে পড়ছে মরা নদীতে, যা থেকে উত্কট গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ নদী তীরে রয়েছে অসংখ্য ঝুলন্ত ও খোলা পায়খানা। এসব পায়খানা থেকে নির্গত মানব বর্জ্য এবং ড্রেন ও নালা-নর্দমা থেকে বয়ে আসা ময়লা-আবর্জনা বিষাক্ত করে তুলছে নদীর পানিকে। এই পানিতেই নিম্নবিত্ত ও ভাসমান পরিবারের শিশু-কিশোররা গোসল করে, সাঁতার কাটে, মহিলারা রান্নাবান্নায় ধোয়া-মোছার কাজ করে।’
আদর্শ সদর উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত পুরাতন গোমতী নদীর অবৈধ দখলদারের ৭৭২ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। তাদের উচ্ছেদের জন্য ২০০৩ সাল থেকে ৮-৯ দফা নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিকসহ নানা কারণে আজও তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। এদিকে ২০১৫ সালে আদর্শ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নদীর অবৈধ দখলীয় খাসজমি ও জলাভূমির তথ্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রেরণ করেন। ঐ তথ্যে কৃষিজমি ১৫৬.৭৪ একর এবং অকৃষি খাসজমি ১০২ একরসহ মোট ২৫৮.০২ একর উল্লেখ করে ঐ জমি দখলমুক্ত করার অনুরোধ করা হয়েছিল। এরপর ২০১৬ সালে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হলেও অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ হয়নি।
কুমিল্লা নাগরিক ফোরামের সভাপতি কামরুল আহসান বাবুল বলেন, ‘একসময় ঢাকার হাতিরঝিল এলাকাও অবহেলিত ছিল, নাকে রুমাল দিয়ে ঐ এলাকায় চলাচল করতে হতো। কিন্তু সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় হাতিরঝিল এখন অপূর্ব এক দর্শনীয় এলাকা। হাতিরঝিলের আদলে এখানেও বিনোদন পার্ক গড়ে তোলা যেতে পারে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা শাখার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রশাসনের চোখের সামনে শহরের পুরাতন গোমতী নদীটি দিনে দিনে দখলে-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ‘পুরাতন গোমতী নদী ঘিরে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন এলাকা গড়ে তোলার জন্য জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সিটি করপোরেশন সমন্বয়ে মহাপরিকল্পনা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। এজন্য নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিদের পরামর্শ নিয়ে সহসাই প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।’
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর বলেন, ‘পুরাতন গোমতী নদীর দুই পাড়ের অবৈধ দখলদারদের তালিকা হয়েছে, তাদের উচ্ছেদ করা হবে।
সূত্রঃ ইত্তেফাক