‘আবর্জনার মতো লাগে’, তাই বিভাজকের অর্ধশত বকুলগাছ কাটলেন তিনি

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঢাকামুখী লেন দিয়ে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার রেলওয়ে ওভারপাস পার হতেই বেলতলী এলাকা। এই এলাকায় মহাসড়কের বিভাজকে থাকা সারি সারি বকুলগাছ যে কারোরই মন কেড়ে নেয়। গাছগুলো দেশের ব্যস্ততম এই মহাসড়কের সৌন্দর্যও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মহাসড়কটির সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য এসব গাছ লাগানো হয়েছিল সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের উদ্যোগে।

তবে বেলতলী এলাকায় নির্মিত শিশু হাসপাতালের সামনে যেতেই চোখে পড়ে ভিন্ন এক চিত্র। এই এলাকায় মহাসড়কের বিভাজকের সারি সারি বকুলগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এসব গাছের কোথাও কেটে নেওয়া হয়েছে গোড়া থেকে, আবার কোনোটি কাটা হয়েছে মাঝখানে। বেশ কিছু গাছ আগুনে পুড়িয়ে রাখা হয়েছে কেটে ফেলার জন্য। প্রায় ৫০০ মিটার এলাকায় এভাবেই অন্তত ৫২টি বকুলগাছ কেটে ফেলা হয়েছে।

বেলতলী এলাকায় মহাসড়কের চট্টগ্রামমুখী লেনের পাশে দেড় দশক ধরে চা বিক্রি করেন স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল কুদ্দুস। বকুলগাছগুলোর প্রসঙ্গ তুলতেই ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন, ‘রাস্তার ওই পাশে গিয়া টিনের ঘরে জিজ্ঞেস করেন। কত সুন্দর গাছডি কাইট্টা ফালাইছে। আহ, কত সুন্দর আছিলো বকুলগাছডি। সে বকুলগাছ কাইট্টা ডিভাইডারে কলাগাছ আর শাকসবজি লাগাইছে।’

আবদুল কুদ্দুসের কথা ধরে তাকাতেই মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনের পাশে শিশু হাসপাতালের ফটকসংলগ্ন স্থানে একটি ছোট্ট টিনের ঘর চোখে পড়ল। সেখানে গিয়ে পাওয়া যায় মো. আজমির হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে। তিনি দোচালা ওই টিনের ঘরের একাংশে থাকেন, অন্য অংশে চা-বিস্কুট বিক্রি করেন। ৩৭ বছর বয়সী মো. আজমির হোসেনের বাড়ি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার সাওড়াতলী গ্রামে।

বিভাজকের গাছগুলো কে কেটেছে—জিজ্ঞাসা করতেই আজমির হোসেন বলেন, ‘ডিভাইডারের এই গাছগুলো আবর্জনার মতো লাগে, কোনো কামের না। এর লাইগ্যা কাইট্টা ফালাইছি। এইখানে এখন কলাগাছ, কাঁঠাল, আম, পেঁপেগাছ লাগাইতেছি। আর জায়গাটার মধ্যে শাকসবজির চাষ করমু। মানুষে আমারে কইতাছে তুমি একটা ভালো কাজ করছ। এই জায়গা থাইক্কা মানুষ ফল ও সবজি খাইতে পারব। কাটার পর কিছু গাছ আমি আনছি আর কিছু মাইনসে নিছে লাকড়ির জন্য। আরও কিছু গাছ কাইট্টা ফলগাছ লাগামু। মাইনসে খাইয়া দোয়া করব।’

স্থানীয় এলাকার অন্তত পাঁচজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানান, আজমির হোসেন একটি গাছ দু-তিন দিনে একটু একটু করে কেটে মেরে ফেলেছেন। কোনো কোনো গাছে আগুন লাগিয়ে দিয়ে মেরে ফেলে পরে লাকড়ির জন্য কেটে নিয়েছেন।

কুমিল্লা গার্ডেনার্স সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা আবু মোহাম্মদ নাঈম পেশায় চিকিৎসক হলেও সবার কাছে তিনি ‘গাছের বন্ধু’ নামে পরিচিত। প্রতিদিন এই পথ দিয়ে কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করেন তিনি। আবু মোহাম্মদ নাঈম ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক মাস ধরেই লক্ষ করছি, একটু একটু করে গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। একটি গাছের প্রথমে ডালপালা এবং পরে কয়েক ধাপে পুরো গাছই নাই হয়ে যাচ্ছে। আমি বিষয়টি কয়েক দিন ধরে লক্ষ রাখছিলাম। সকালে যাওয়ার সময় এক রকম দেখি, বিকেলে ফেরার সময় আরেক রকম। কোনো কোনো গাছ আজকে সবুজ দেখেছি, পরের দিন দেখি আগুনে পোড়া।’

আবু মোহাম্মদ নাঈম আরও বলেন, ‘এভাবে গাছ কেটে পরিবেশের ক্ষতি করা হয়েছে। এই বকুলগাছগুলো মহাসড়কের সৌন্দর্য অনেক বাড়িয়েছিল। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর বকুল ফুলের সৌরভ পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। যে বা যারাই গাছগুলো কেটেছে, আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’

সওজ সূত্র জানায়, মহাসড়কটি ২০১৬ সালে চার লেনে রূপান্তর করার পর সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি এক লেনের গাড়ির হেডলাইটের আলো যাতে অন্য লেনের গাড়ির ওপর না পড়ে, সে জন্য বিভাজকের ওপর লাগানো হয়েছিল বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। মহাসড়কের বিভাজকটি কোথাও ফুল গাছে, আবার কোথাও অন্যান্য বৃক্ষে সাজানো হয়েছে। কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত প্রায় ১৯২ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে মহাসড়কের প্রায় ১৪৩ কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। তাঁর মধ্যে রয়েছে বকুল, কাঞ্চন, করবী, গন্ধরাজ, রাধাচূড়া, হৈমন্তী, টগর, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, কদম, পলাশসহ নানান ফুলের গাছ। এ রকম ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি। এ ছাড়া সড়কের পাশে এবং বিভিন্ন স্থানে বিভাজকের ওপর লাগানো হয়েছে জলপাই, অর্জুন, কাঁঠাল, মেহগনি, শিশু, আকাশমণি, নিম, একাশিয়া, হরীতকীসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৪০ হাজারের বেশি গাছ। কুমিল্লার বেলতলী এলাকাটি বকুলগাছে সাজানো হয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, ৫০০ মিটার এলাকার মধ্যে হাসপাতালের সামনের অংশে প্রায় ৩০০ মিটার এলাকাজুড়ে গাছের কোনো অস্তিত্ব নেই। বিভাজকের এই স্থান এরই মধ্যে সবজি চাষের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। কোথাও লাগানো হয়েছে পুঁইশাক, কোথাও মিষ্টিকুমড়া আবার কোথাও লাউ। বিভাজকের মাঝখানে লাগানো হয়েছে কলা, কাঁঠাল ও আমের চারাও।

স্থানীয় বাসিন্দা মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই গাছগুলো মহাসড়কটির সৌন্দর্য অনেক বাড়িয়ে তুলেছে। যেখানে আমাদের প্রতিনিয়ত গাছ লাগানো দরকার, সেখানে উল্টো গাছ মেরে ফেলা হচ্ছে। আমরা এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’

বুধবার দুপুরে বিষয়টি নজরে আনা হলে সওজ কুমিল্লার উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো.আদনান ইবনে হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এরই মধ্যে বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমাদের লোকজন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেছে। সেখান থেকে থানায় গিয়ে এ ঘটনায় আমাদের পক্ষ থেকে একটি জিডি বা অভিযোগ দায়ের করা হবে। এ ছাড়া গাছগুলো রক্ষায় আমাদের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এভাবে গাছ কাটা কোনো সুস্থ মানুষের কাজ হতে পারে না।’

সূত্র: প্রথম আলো

আরো পড়ুন