সরকারী কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধ ভারতীয় পণ্যে সয়লাভ কুমিল্লার মার্কেটগুলো

কুমিল্লা নগরীর মার্কেটগুলোতে অবাধে ঢুকছে ভারতীয় শাড়ি, কসমেটিক্সসহ অন্যান্য সামগ্রী। অফিসিয়ালি কোনো নিলামের ঘোষণা নেই, নেই সরকারি কোনো নথি। তবুও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে হাজার হাজার পিস ভারতীয় শাড়ি থেকে শুরু করে নানা ভারতীয় পণ্য ঢুকে যাচ্ছে শহরের অভিজাত বিপণিবিতানগুলোতে। ফলে একদিকে যেমন সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। অপরদিকে, চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে দেশে উৎপাদিত পণ্যগুলো। কিন্তু এ সকল বিষয়গুলো যাদের দেখার কথা তাদের নির্লিপ্ততা কিংবা রহস্যজনক নিরবতার কারণে এ প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।

সম্প্রতি নগরীর কান্দিরপাড়স্থ অভিজাত বিপণী বিতান প্ল্যানেট এস আর এ ৬৬০ পিস অবৈধ ভারতীয় শাড়ির ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে অবৈধ ভারতীয় পণ্যের বাজারজাতকরণের ভয়াভহ তথ্য। প্ল্যানেট এস আর এর ব্যবসায়ী আবদুল মান্নান বলেছেন, ১০ বিজিবিসহ বিজিবির বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন নিয়মিত ভাবে অবৈধ ভারতীয় পণ্যের নিলাম করে থাকে। আমরা তাদের থেকে কিনে আনি। অপরদিকে, ১০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল মীর আলী এজাজ এ ধরণের অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেছেন, বিজিবি কোন ধরনের নিলাম করতে পারে না। প্রতিবেদকের সাথে বলা এই দুই জনের বক্তব্যই রেকর্ড আছে।

সরেজমিন ৬৬০ পিস ভারতীয় শাড়ির ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। কথিত “বিজিবির নিলাম” দেখিয়ে গোটা একটি নেটওয়ার্ক দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্য করে যাচ্ছে কোটি টাকার ভারতীয় পণ্যের।

১০ বিজিবি বলছে, এ ধরনের নিলামের কোনো অস্তিত্বই নেই; অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, নিলাম হয় নিয়মিতই এবং এতে ক্যাম্পের লোকজনের সরাসরি ভূমিকা থাকে। ফলে কুমিল্লা নগরীসহ সারা জেলায় অসংখ্য মার্কেটে দাপটের সাথে বিক্রি হচ্ছে অবৈধ ভারতীয় পণ্য।

গত ১৫ নভেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় সরেজমিনে দেখা যায়, কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড় প্ল্যানেট এস আর শপিং কমপ্লেক্সের আন্ডার গ্রাউন্ড পার্কিং স্পেসে তড়িঘড়ি করে ঢোকে একটি নোহা মাইক্রোবাস। প্রতিবেদকের সন্দেহ হওয়ায় গাড়িটির পেছনে গেলে দেখা যায়, বস্তাভর্তি শাড়ি নামানো হচ্ছে দ্রুতগতিতে। কাছে গিয়ে শাড়িগুলো দেখতে ভারতীয় মনে হওয়ায় গাড়িচালকের কাছে উৎস জানতে চাইলে তিনি নির্দ্বিধায় বলেন, “কোটবাড়ি ১০ বিজিবি ক্যাম্প থেকে নিলামে আনা।” কিছুক্ষণ পরেই সেই শাড়িগুলো মার্কেটের প্রথম ফ্লোরের একটি দোকানে প্রবেশ করতে দেখা যায়।

এই অবৈধ শাড়ির উৎস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই প্রতিবেদক যোগাযোগ করে দোকানের মালিক আবদুল মান্নানের সাথে। প্রতিবেদককে তিনি জানান, তিনি নিয়মিতই ১০ বিজিবি, সুলতানপুর ৬০ বিজিবি এমনকি ফেনী থেকেও বিভিন্ন নিলাম থেকে ভারতীয় পণ্য কেনেন। তার দাবি, গত শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) ১০ বিজিবির সিও’র তত্ত্বাবধানে তিনি ৯ লাখ ৫ হাজার টাকায় ৬৬০ পিস শাড়ি কিনেছেন। শুধু শাড়ি নয়, রসুন, কসমেটিকসসহ আরও অনেক পণ্য নাকি ওই নিলামে উঠেছিল। এরপর তিনি আরও জানান, আগে এসব নিলামে ডকুমেন্ট দেওয়া হতো; কিন্তু কিছুদিন পূর্বে সুলতানপুরে নিলামের এক চালানে পণ্যের সাথে মদ মেলায় নাকি এখন আর কাগজপত্র দেওয়া হয় না।

ব্যবসায়ী আবদুল মান্নানের দাবি, এসব নিলামের টাকা সরকার পায় না। এসব সোর্সকে কিছু অংশ দিয়ে, বাকী অংশ বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা ভাগ ভাটোয়ারা করে নেয়। এ কারণে, এখন আর কোনো ধরণের ডকুমেন্টস দেওয়া হয় না। তার ভাষ্য অনুযায়ী, এক থেকে দেড়শো লোকের সামনে এসব নিলাম হয় এবং ট্রাকের এন্ট্রি ও ডেলিভারি দেন বিজিবির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা।

তবে বিজিবির পক্ষ থেকে এই দাবি পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে। নিলামের বিষয়ে জানতে ১০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল মীর আলী এজাজকে ফোন করলে তিনি বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, “বিজিবি কোনো ধরনের নিলাম করতে পারে না। বিজিবি ক্যাম্পে কাস্টমসের মাধ্যমে কিছু নিলাম হয়, যেসব পণ্য কাস্টমস অফিসে নেওয়া সম্ভব হয় না। তবে সে সময় কাস্টমস অফিসাররা সেখানে থাকেন। বিজিবি ক্যাম্পে এমন নিলাম হয়েছিল কয়েক সপ্তাহ আগে। শুক্রবার এ ধরনের নিলাম হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে জানান ১০ বিজিবির অধিনায়ক।

পরে ব্যবসায়ী আবদুল মান্নানের বিজিবি গেইটে নাম এন্ট্রি ও পন্য সরবরাহের দাবির বিষয়ে পুনরায় জানতে চাইলে বিজিবি অধিনায়ক বলেন, “আমাদের এখানে কাস্টমসের উপস্থিতিতে নিলাম হয়, তখন গেইটে এন্ট্রি হয়। তবে এর মধ্যে এমন কোনো নিলাম হয়নি। এসব গল্প ওই ব্যক্তি কীভাবে বললো, তা আমার জানা নেই। বিজিবির নাম ভাঙানো হচ্ছে এখানে। ওই লোক নিজেই হয়তো চোরাকারবারির সাথে জড়িত। তাই এসব বলছে। গত দুই এক সপ্তাহের মধ্যে এ ধরনের কোনো নিলাম হয়নি। বিজিবির নাম ভাঙিয়ে এসব করা হচ্ছে, এর সাথে বিজিবির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জাফর সাদিক চৌধুরী বলেন, বিষয়টি আপনার মাধ্যমে শুনেছি৷ আপনার তথ্যটি আমাদের কাজে লাগবে। যদিও বিজিবি আমাদের আওতাধীন নয়৷ তবে, সংশ্লিষ্ট অথোরিটিকে আমরা বিষয়টি জানাতে পারবো। আমরা আগামীতে সতর্ক থাকবো এ বিষয়ে।

এদিকে, সচেতন মহল মনে করেন, যদি বিজিবি নিলাম না করে, তাহলে এই বিশাল পরিমাণ ভারতীয় পণ্য কোথা থেকে এলো। কিভাবে ট্রাক বিজিবি ক্যাম্পের গেইটে এন্ট্রি পেল, কার নির্দেশে ডেলিভারি হলো। আর যদি নিলাম হয়ে থাকে, তাহলে কেন ডকুমেন্ট নেই, কারা পাচ্ছে বিপুল ওই অর্থ, এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা। তবে যে বাস্তবতা সামনে এসেছে, তা উদ্বেগজনক।

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি বদরুল হুদা জেনু বলেন, ‘যদি এমন ঘটনা সত্যিকার অর্থেই ঘটে থাকে, তাহলে এটি বিধি বহির্ভূত কাজ। কারণ, বিজিবি নিজে কোনো পণ্য নিলাম দিতে পারে না, সেটা কাস্টমসের মাধ্যমে নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় নিলাম করা হয়৷ আর অবৈধ ভারতীয় পণ্যের কারণে বাজারে অস্থিরতাও তৈরী হয়ে থাকে। তাই এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সচেতন থাকতে হবে।

কুমিল্লা নগরীর অভিজাত বিপণিবিতানের আন্ডারগ্রাউন্ডে ভারতীয় শাড়ির বস্তা নামানো দৃশ্যটাই বলে দেয়, অভ্যন্তরে কিছু একটা চলছে। এর দায় কার, বাণিজ্যিক চক্র, না কি দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো অংশ, তা বের করতে জরুরি প্রয়োজন স্বচ্ছ তদন্তের। না হলে অবৈধ ভারতীয় পণ্যের বন্যায় বাজার ভরবে, অথচ শূন্য থেকে যাবে সরকারি কোষাগার।

আরো পড়ুন