কুমিল্লায় এইচএসসির কেন্দ্র স্থাপনে নজিরবিহীন অনিয়ম
ডেস্ক রিপোর্টঃ নীতিমালা না থাকার সুযোগে আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে নিজেদের সুবিধামতো স্থানে পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ নিয়েছে। শহরে ক্যাম্পাস এমন ৩০টির বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শহরের বিভিন্ন উপজেলার গ্রামাঞ্চলে তাদের পরীক্ষার্থীদের জন্য কেন্দ্র পেয়েছে।
অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবার নিজেদের পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্র ক্যাম্পাস থেকে ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে পেয়েছে। ইতোমধ্যে এসব কেন্দ্রের পরীক্ষাথীরা কেন্দ্র-সংলগ্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে রেখেছে। আবার কোনো কোনো কলেজের নামে কেন্দ্র আছে, কিন্তু তারা নিজেদের কলেজে কেন্দ্র স্থাপন না করে কেন্দ্র হিসেবে পাশের স্কুল কিংবা মাদ্রাসাকে ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড প্রণীত ২০১৮ সালের এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র তালিকা অনুসন্ধানে শুধু কুমিল্লা জেলায়ই এমন ৪২টি প্রাইমারি স্কুল ও মাদ্রাসার নাম পাওয়া গেছে, যেগুলোকে কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে রাস্তার পাশে থাকা কলেজগুলো। ফলে কলেজের পরীক্ষার জন্য ওই ৪২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা বন্ধ রাখতে হবে প্রায় দেড় মাস।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অন্তত অর্ধশতাধিক স্কুল ও কলেজ দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে শিক্ষার নামে এক ধরনের ব্যবসা করে আসছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস রয়েছে নগরীর বিভিন্ন এলাকায়, আর তাদের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেয় দূরের কোনো উপজেলার পরীক্ষাকেন্দ্রে। এতে পরীক্ষার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। শিক্ষা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই বছরের পর বছর এমন ঘটনা ঘটছে।
ময়নামতি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার নিশ্চিন্তপুরে অবস্থিত। এখানে ৩শ গজের মধ্যে রয়েছে দুটি পরীক্ষাকেন্দ্র। তারপরও ময়নামতি কলেজের পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্র দেওয়া হয়েছে ৮ কিলোমিটার দূরে বুড়িচং উপজেলার পারুয়ারা আবদুল মতিন খসরু কলেজে। আগে ময়নামতি কলেজের পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল রামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। কুমিল্লা নগরীর কোটবাড়ীতে অবস্থিত কুমিল্লা সিটি কলেজে। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র দেওয়া হয়েছে ১০ কিলোমিটার দূরে বরুড়া উপজেলার আগানগড় আদর্শ কলেজে। আগে কুমিল্লা সিটি কলেজের পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল ভ্যানু আগানগড় উচ্চ বিদ্যালয়ে। অথচ কুমিল্লা সিটি কলেজ থেকে ৫শ মিটার দূরেই রয়েছে টিটিসি কেন্দ্র। নিশ্চিন্তপুরে অবস্থিত কুমিল্লা পাঠশালা কলেজ। ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা এবার পরীক্ষা দেবে ১০ কিলোমিটার দূরে মিনসার জুনাব আলী কলেজ কেন্দ্রে।
বুড়িচং উপজেলার সোনার বাংলা কলেজের পরীক্ষার্থীদের জন্য পাশের ভরাসার উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে শুধু সোনার বাংলা কলেজের শিক্ষার্থীরাই পরীক্ষা দেবে। বুড়িচং এরশাদ কলেজের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র পড়েছে পাশের বুড়িচং আনন্দ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এখানে শুধু এরশাদ কলেজের শিক্ষার্থীই পরীক্ষা দেবে। অথচ বুড়িচং এরশাদ কলেজ ও সোনার বাংলা কলেজের দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার। ওই দুই কলেজের কেন্দ্র অন্যান্য কেন্দ্রের মতো বিনিময় করা যেত। তাতে পরীক্ষার জন্য দুটি স্কুল বন্ধ রাখতে হতো না। বুড়িচংয়ের সংকুচাইল কলেজের পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্র সংকুচাইল উচ্চ বিদ্যালয়ে। অথচ এ কলেজের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র অনায়াসেই বুড়িচং এরশাদ কলেজে হতে পারত।
কুমিল্লা নগরীতে ক্যাম্পাস রয়েছে এমন অন্তত আটটি কলেজের মূল ঠিকানা বিভিন্ন উপজেলায়। তিন উপজেলায় কর্মপরিধি থাকা এসব কলেজের মূল ঠিকানায় তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। কুমিল্লা মহানগর কলেজ এমনই একটি প্রতিষ্ঠান। নগরীর প্রাণকেন্দ্র ঝাউতলায় এর ক্যাম্পাস। অথচ এটির পরীক্ষাকেন্দ্র ২০ কিলোমিটার দূরে চান্দিনা উপজেলার চান্দিনা মহিলা কলেজে। কলেজটির অনুমোদন নেওয়া হয়েছে দেবিদ্বার উপজেলার ঠিকানায়। একই কেন্দ্রে পরীক্ষা দেবে বরুড়া উপজেলার খোসবাস উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের পরীক্ষার্থীরা।
রূপসীবাংলা কলেজের ক্যাম্পাস সদর দক্ষিণ উপজেলার নোয়াগাঁও দেখানো হলেও সেখানে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব নেই। পাঠদান করা হয় কুমিল্লা নগরীর হাইজিং এস্টেট এলাকায়। আর শিক্ষার্থীরা এইচএসসি পরীক্ষা দেয় ২০ কিলোমিটার দূরে সদর দক্ষিণ উপজেলার দীঘিরপার টিআইকে মেমোরিয়াল কলেজ কেন্দ্র। একই কেন্দ্রে পরীক্ষা দেবে নগরীর শাকতলার ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল কলেজ এবং নগরীর পাদদেশে অবস্থিত চাঁদপুর জনতা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের পরীক্ষার্থীরা। অথচ নগরীতে অবস্থিত ওই কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা নগরীর একাধিক কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে পারত।
এ ছাড়াও কুমিল্লা নগরীর হাজী আক্রাম উদ্দিন স্কুল ও কলেজ তাদের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র নিয়ে গেছে ১৫ কিলোমিটার দূরে লালমাই কলেজ কেন্দ্রে।
এ ছাড়া নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাড়তি সুযোগ নিতে বুড়িচং এরশাদ কলেজ, সোনার বাংলা কলেজ, চৌয়ারা আদর্শ কলেজ, ছোট শরীফপুর কলেজ, চৌদ্দগ্রাম সরকারি কলেজ, আলহাজ নূর মিয়া কলেজ, গুণবতী কলেজ, বিজয়করা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, চিওড়া সরকারি কলেজ, কাশীনগর কলেজ, নুরুল আমিন মজুমদার কলেজ, শাহ শরীফ কলেজ, চলন কলেজসহ অর্ধশতাধিক কলেজ তাদের কলেজের পাশের স্কুলকে কেন্দ্র হিসেবে নিয়েছে। রহস্যজনকভাবে শিক্ষা বোর্ডও তাদের অনুমোদন দিয়েছে অবলীলায়।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কায়সার আহমেদ বলেন, কুমিল্লা মডেল কলেজসহ নগরীতে বেশ কিছু কলেজ রয়েছে, যেগুলোর এক জায়গার নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আর ক্লাস চলে নগরীতে এবং পরীক্ষাকেন্দ্র দূরে। এসব অসঙ্গতি আগামীতে দূর করা হবে।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুস সালাম জানান, তিনি ঢাকায় আছেন, কুমিল্লায় গিয়ে এসব বিষয় গুরুত্বসহকারে দেখবেন।
সূত্রঃ আমাদের সময়