কুমিল্লায় প্রতিদিন ভাঙছে ২৩ সংসার

তিন বছর আগে কুমিল্লা নগরীর অশোকতলা এলাকার মিম আকতারের বিয়ে হয় কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার চিপস ব্যবসায়ী ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে। কিন্তু টেকেনি তাদের সংসার। ফরহাদ জানালেন, তার স্ত্রী মিম অনলাইনে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। অনলাইনে ব্যবসার সুবাদে এ সময় তার পরিচয় হয় এক ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে। পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন মিম। স্ত্রীর ফেসবুক মেসেঞ্জার ও ইমু দেখে বিষয়টি নিশ্চিত হন ফরহাদ। এ নিয়ে শুরু হয় তাদের দাম্পত্য কলহ। একপর্যায়ে এক বছরের ছেলেকে রেখে মিম চলে যান গত বছরের ডিসেম্বরে পরকীয়া প্রেমিক ওই ব্যাংক কর্মকর্তার ঘরে। স্ত্রীকে তালাক দেন ফরহাদ।

জেলার শহরতলী ধর্মপুর এলাকার লাবিবা আক্তার মুনকে পাঁচ বছর আগে তার বাবা বিয়ে দেন জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কনকাপৈত ইউনিয়নের কালকোট গ্রামের মামুন সর্দারের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। কিন্তু প্রায় প্রতি রাতেই মাদক সেবন করে ঘরে ফিরত মামুন। মুন জানান, ছোটখাটো ঘটনায় তার গায়ে হাত তুলতেন তার স্বামী। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে গত নভেম্বর মাসে স্বামীকে তালাক দিতে বাধ্য হন মুন। দুই শিশু নিয়ে তিনি এখন থাকেন বাবার বাড়িতে।

শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুমিল্লা জেলায় বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ব্যাপক হারে বেড়েছে। গত চার বছরের ব্যবধানে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে প্রায় তিনগুণ।

কুমিল্লা জেলা নিবন্ধক কার্যালয়ের সূত্রমতে, ২০১৯ সালে মুসলিম বিবাহ নিবন্ধন হয়েছে ২১ হাজার ৭৭১টি, সেই বছর তালাক হয়েছে ৩ হাজার ২৩০টি। ২০২০ সালে বিবাহ নিবন্ধন হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭০টি, সেই সময়ে সংসার ভেঙেছে ৫ হাজার ৮৩৩টি। ২০২১ সালে বিবাহ নিবন্ধন হয়েছে ২৬ হাজার ৭২০টি, তালাক হয়েছে ৬ হাজার ২০৬ পরিবারের। ২০২২ সালে বিবাহ নিবন্ধন হয়েছে ৩৩ হাজার ০১৩টি, সংসার ভেঙেছে ৮ হাজার ১০৭টি পরিবারের। এ হিসাবে কুমিল্লায় দৈনিক গড়ে ২৩টি সংসার ভাঙছে।

কুমিল্লা মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার কল্যাণ সমিতির নেতা কাজী মুফতী বেলাল হোসাইন বলেন, জেলায় আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষরাই স্ত্রীদের তালাক দিতেন। এখন নারীরা তার স্বামীকে তালাক দিচ্ছে বেশি। তবে বেশিরভাগ তালাক হচ্ছে পরকীয়ার কারণে। এ ছাড়া সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে সাম্প্রতিক সময় ব্যাপক হারে বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে।

কুমিল্লা জেলা রেজিস্ট্রার আসাদুল ইসলাম বলেন, বেশ কয়েকটি কারণে তালাকের ঘটনা বেড়েছে। মোবাইল ফোন ও ফেসবুকের কারণে পরকীয়া বেড়ে যাওয়ায় অনেকের সংসার ভেঙে যাচ্ছে। যৌথ পরিবার ও সামাজিক বন্ধন কমে যাওয়ায়ও তালাকের ঘটনা বাড়ছে। শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ায় অনেক নারী বিভিন্ন কারণে এখন তার স্বামীকে তালাক দিচ্ছেন, যে প্রবণতা আগে অনেক কম ছিল। তিনি জানান, এর বাইরে যৌতুক, মাদকাসক্তি প্রভৃতি কারণেও তালাকের সংখ্যা বেড়েছে।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের কয়েকজন শিক্ষক জানান, কেউ ভালোবেসে আবার কেউ পরিবারের সিদ্ধান্তে বিয়ে করছেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আগের তুলনায় পারস্পরিক বিশ্বাস কমে গিয়ে দাম্পত্য কলহ বেড়েছে। ফুটফুটে সন্তান, সুন্দর সংসার ও মধুর সম্পর্কের স্মৃতি কোনো কিছুই বিচ্ছেদ আটকাতে পারছে না। যৌতুক, মাদকাসক্তি, বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব, পরকীয়া, সন্দেহ, একাধিক বিয়ের প্রবণতা প্রভৃতি কারণে সংসার ভেঙে যাচ্ছে। উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে এ বিচ্ছেদের হার বেশি। এর প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর।

আরো পড়ুন