কুমিল্লায় বীরচন্দ্র পাঠাগারে আগুন, ২০০ বছরের পুরনো বই-পুঁথি লুট

এই পাঠাগারে ১০০ বছর আগের বই ছিলো পাঁচ হাজারের বেশি।

তীব্র গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পর বিজয় মিছিল থেকে একদল লোক এসে প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো কুমিল্লার বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনে হামলা- ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর লুটপাট চালায়। এতে পাঠাগারে সংরক্ষিত প্রায় দুই বছরের পুরনো বই, পুঁথি লুট হয়ে গেছে।

তবে সোমবার বিকালে কারা এই হামলা চালিয়েছে তা নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। পুলিশ প্রশাসন কার্যকর না থাকায় পাঠাগার কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না।

এই অবস্থায় কুমিল্লার বিশিষ্ট নাগরিক, গবেষক, শিক্ষাবিদসহ রাজনৈতিক দলের নেতারা লুট হওয়া দুষ্প্রাপ্য এসব ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

১৮৮৫ সালে ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের দান করা নগরীর কান্দিরপাড়ের জমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনটি। সবার কাছে এটি ‘টাউন হল’ নামেই বেশি পরিচিত। পাঠাগারটিতে ১৩৯ বছরে প্রায় ২৫ হাজার বইয়ের সংগ্রহ গড়ে ওঠেছিল। দুষ্প্রাপ্র বইয়ে ভরপুর এই গণপাঠাগারটির অস্তিত্বেই এখন হুমকির মুখে পড়েছে।

টাউন হলের দোতলার উত্তর অংশে অবস্থিত পাঠাগার ভাঙচুরের পাশাপাশি ২০০ বছরের পুরনো হাজার হাজার বইয়ের শেলফে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পাঠাগারের তত্ত্বাবধায়ক রঞ্জিত বলেন, খাবার খাওয়ার জন্য সোমবার দুপুরে তিনি বাইরে গিয়েছিলেন। একটু পরেই তিনি জানতে পারেন গণপাঠাগারে হামলা হয়েছে।

তিনি বলছিলেন, ঘটনার সময় হামলাকারীরা প্রথমে তত্ত্বাবধায়কের কক্ষে প্রবেশ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে সেখানে থাকা কিছু বই পুড়ে যায়। পরে টাউন হলের মুক্তিযোদ্ধা কর্নারে আগুন দেওয়া হয়। এরপর দ্বিতীয় তলায় প্রবেশ করে ভাঙচুর করে ও আগুন দেয়। এ সময় লুটপাট হয়।

বৃহস্পতিবার বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনে গিয়ে ভাঙচুরের চিহ্ন ও আগুনে পোড়া বইয়ের ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ে। দোতলার সবগুলো বইয়ের আলমারি ভাঙা। অনেক ম্যাগাজিন, ভাঙা কাচের টুকরো ও বেশ কিছু বই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নিচের প্রবেশপথে পাঠাগার তত্ত্বাবধায়কের কক্ষটি পোড়া।

এদিকে, এ ঘটনার পর থেকেই ঐতিহ্যবাহী এই পাঠাগারের লুট হওয়া বই ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন নগরীর বিশিষ্টজনরা। এদের মধ্যে লালমাই কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান, সিপিবি নেতা শেখ আবদুল মান্নান, কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর, রাজনীতিবিদ শাহ মোহাম্মদ সেলিম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব খায়রুল আনাম রায়হান, ঐতিহ্য কুমিল্লার পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ইমরুলসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন।

লুট হয়ে যাওয়া বইগুলো জাতীয় সম্পদ উল্লেখ করে বিশিষ্টজনবা বলেছেন, বীরচন্দ্র গণপাঠাগারের বইগুলো কেবল কুমিল্লার নয়, বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ। তাই যারাই বুঝে বা না বুঝে লুট করেছেন, তাদের বইগুলো ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।

গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, “বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন আমাদের গর্বের জায়গা। এখানে এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকার প্রথম সংখ্যা থেকে প্রায় সবকটি সংখ্যাই ছিল। এখানে মহাকবি ফেরদৌসির রচিত শাহানামার প্রথম সংস্করণের কপি ছিলো। এই পাঠাগারে ১০০ বছর আগের বই ছিলো পাঁচ হাজারের বেশি। আধি রাজমালার প্রথম সংস্করণেরও কপি ছিলো। অনেকগুলো মূল্যবান পুঁথি ছিলো। যা শুধু কুমিল্লার নয়, বাংলাদেশের জন্য অমূল্য সম্পদ।”

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী আবু সুফিয়ান রাসেল বলেন, “টাউন হলের বইগুলো যারা লুট করেছেন- তারা দয়া করে বইগুলো ফিরিয়ে দিন। এতে নতুন প্রজন্ম অনেক ইতিহাস জানতে পারবে।”

এদিকে, বৃহস্পতিবার দুপুরে কুমিল্লা জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনের বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকজন বক্তব্য দেন।

পরে জেলার সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে জেলা প্রশাসক খন্দকার মুশফিকুর রহমান ও পুলিশ সুপার মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, প্রশাসন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কাজ করছে। গণপাঠাগারের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে।

আরো পড়ুন