কুমিল্লায় অস্ত্রের লাইসেন্স ক্যাডার ও বিতর্কিতদের
আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেতে কারও ছিল মন্ত্রী কিংবা এমপির জোর সুপারিশ। কারও ছিল টাকার জোর। যিনি যেভাবে পেরেছেন, বাগিয়ে নিয়েছেন লাইসেন্স। আওয়ামী লীগের গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে কুমিল্লায় অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে মূলমন্ত্র ছিল ক্ষমতাসীন পক্ষের কিনা। এতে সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র থেকে শুরু করে বিতর্কিত কাউন্সিলর, ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও পেয়েছেন অস্ত্রের লাইসেন্স। বাদ যাননি দলীয় ক্যাডাররাও। তাদের মধ্যে বৈধ অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া দিয়ে ভাইরাল হয়েছেন কেউ কেউ। জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পর্যালোচনায় বেরিয়ে এসেছে এমন চিত্র।
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শামসুল তাবরীজ জানান, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত কুমিল্লার ১৮ থানায় ২০৯টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৫ জন অস্ত্র কেনেননি। সরকারি নির্দেশের পর বাকি ১৯৪ লাইসেন্সধারীর মধ্যে ৯ জন ছাড়া সবাই ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় অস্ত্র জমা দিয়েছেন।
জেলার থানাগুলো থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে ব্যক্তি পর্যায়ে ইস্যু করা অধিকাংশ লাইসেন্সই পেয়েছেন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী ও অনুসারীরা। এর মধ্যে সদর আসনের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার সমর্থিত নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, দলীয় ক্যাডার ও অনুসারীরাই নিয়েছেন তিন ডজনের বেশি পিস্তল, শটগান ও বন্দুকের লাইসেন্স। বাহার নিজে শটগানের লাইসেন্স নেন ২০১৩ সালে। তাঁর বড় মেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) সাবেক মেয়র তাহসীন বাহার সূচনার স্বামী সাইফুল আলম রনিও নিয়েছেন বৈধ অস্ত্র। এ ছাড়া লাইসেন্স পাওয়া বাহার অনুসারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন– কুসিকের প্রয়াত মেয়র আরফানুল হক রিফাত, সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম টুটুল, মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক জিএস সহিদ, কুসিকের বিতর্কিত কাউন্সিলর ও হত্যা মামলার আসামি সৈয়দ রায়হান আহমেদ, মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আলী মনসুর ফারুক, ঠিকাদার আবুল হোসাইন ছোটন, ব্যবসায়ী শফিউল আলম, আইয়ুব আলী ভূঁইয়া, ২২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল মালেক ভূঁইয়া, ইউপি চেয়ারম্যান সেকান্দর আলী, বাহারের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান পিয়াস, ভাতিজা হাবিবুর আল আমিন সাদী প্রমুখ। পুলিশ বলছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি চালানোর মামলায় বাহার অনুসারী এসব নেতার অধিকাংশ এখন আত্মগোপনে।
অন্যদিকে, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খান ২০১২ সালে বন্দুকের লাইসেন্স নেন। ২০১৫ সালে তাঁর স্ত্রী নার্গিস আফজল নেন পিস্তলের লাইসেন্স। এর পর ২০২৩ সালে শটগান ও পিস্তলের লাইসেন্স নেন তাঁর একমাত্র মেয়ে সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এমপি আঞ্জুম সুলতানা সীমা। এ ছাড়া সীমার স্বামী নিসার উদ্দিন আহম্মেদ মিন্টু, ছোট ভাই মাসুদ পারভেজ খান ইমরান ও ডা. আজম খান নোমানেরও রয়েছে বৈধ অস্ত্র। এ বিষয়ে সীমা বলেন, সরকারি সব বিধি মেনেই তারা অস্ত্রের লাইসেন্স নেন। তাঁর বাবা-মা ও ভাই ইমরান এরই মধ্যে মারা যাওয়ায় তাদের নামে বিধি অনুসারে আর লাইসেন্স থাকছে না। বিষয়টি লিখিতভাবে জেলা প্রশাসনকে জানানো আছে।
সাবেক এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র, কাউন্সিলররা তো আছেনই, দলের একাধিক বিতর্কিত নেতাও অস্ত্রের লাইসেন্স বাগিয়েছেন। ২০১৫ সালে পিস্তলের লাইসেন্স পাওয়া মেঘনার মানিকারচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাকির হোসেনের হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজি ও প্রতারণার অভিযোগে বিভিন্ন থানায় ১২টি মামলা রয়েছে।
একাধিকবার গ্রেপ্তারও হয়েছেন। এ ছাড়া সাবেক রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হকের সুপারিশে ২০১৬ সালে চৌদ্দগ্রামের নালঘরের মোস্তফা মনিরুজ্জামান জুয়েল লাইসেন্স পান। দলে তাঁর পদ না থাকলেও পরিচয় দিতেন যুবলীগ নেতা। এলাকায় তিনি মুজিবুল হকের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। ২০২২ সালে প্রকাশ্যে রাইফেল নিয়ে প্রতিপক্ষকে হুমকি দিয়ে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর এলাকা ছাড়েন জুয়েল। আর লাইসেন্স করা পিস্তল কোমরে রেখে গত বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভাইরাল হন বরুড়া উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান।
উত্তরাধিকারসূত্রেও মিলেছে লাইসেন্স। সাবেক এমপি এম এ জাহেরের ভাতিজা মোহাম্মদ আবু ছাইব বাপ্পী ২০২১ সালে পান পিস্তলের লাইসেন্স। আর সদরের দুর্গাপুরের ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী লুৎফুর নাহারকে ২০১৪ সালে দেওয়া হয় পিস্তলের লাইসেন্স।
এ ছাড়া লাইসেন্স পাওয়া নেতাদের মধ্যে আছেন– দেবিদ্বারের সাবেক এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল, আবুল কালাম আজাদ দুটি (পিস্তল ও শটগান), নাসিমুল আলম চৌধুরী নজরুল, এম এ জাহের, আমির হোসেন, সাবেক এমপি বেগম সেলিমা ইসলাম দুটি (পিস্তল ও রাইফেল), নাঙ্গলকোট উপজেলা চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন কালু, বরুড়া উপজেলা চেয়ারম্যান এ এন এম মইনুল ইসলাম (শটগান ও পিস্তল), মেঘনা উপজেলা চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহ মিয়া রতন শিকদার, মুরাদনগর উপজেলা চেয়ারম্যান আহসানুল আলম কিশোর, তিতাস উপজেলা চেয়ারম্যান পারভেজ হোসেন সরকার, মুরাদনগর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল কাইয়ুম খসরু ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান জাকির হোসেন।
পৌর মেয়রদের মধ্যে আছেন– নাঙ্গলকোট পৌরসভার মেয়র আবদুল মালেক, চৌদ্দগ্রামের মিজানুর রহমান, দাউদকান্দির নাঈম ইউসুফ ও তাঁর ভাই নাসিম ইউসুফ।
এ ছাড়া কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সহসভাপতি বশিরুল আলম মিয়াজী, তিতাস যুবলীগ নেতা শাকিল ইসলাম, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক আলী আকবর, দেবিদ্বারের মাশিকাড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাকিম, জেলা পরিষদ সদস্য জসিম উদ্দিন, তিতাস উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া ও দেবিদ্বার যুবলীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার গাজী রাসেলও লাইসেন্স পেয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, জীবনের ঝুঁকি, বছরে ন্যূনতম ২ লাখ টাকা আয়কর রিটার্ন জমাসহ বিভিন্ন শর্ত পূরণ করে কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স পাওয়ার আবেদন করতে পারেন। তবে অনেকে ‘কৌশলে’ বেশি রিটার্ন দেখিয়ে লাইসেন্স নিয়েছেন। আর বিগত সরকারের সময়ে অধিকাংশ লাইসেন্সই দলীয় তদবিরে দেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক আবু বকর সিদ্দিক বলেন, অস্ত্রের লাইসেন্সের বিষয়টা খুব সংবেদনশীল। সরকারিভাবে যথাযথ যাচাই-বাছাই না করে কোনো ব্যক্তিকে যদি লাইসেন্স দেওয়া হয়, তা রাষ্ট্র ও নাগরিক জীবনের জন্য হুমকি।