১২ বছর নিম্নমানের বই ছেপে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাট!
নিম্নমানের পাঠ্যবই ছাপিয়ে গত এক যুগে লুটপাট করা হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা! এর মধ্যে শুধু ২০২৩ সালেই ২৬৯ কোটি ৬৮ লাখ ৯৪ হাজার ৬৪৯ টাকার অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। বইয়ের মান ও আকার কমিয়ে এবং নিউজপ্রিন্টে ছাপিয়ে লোপাট করা হয় ২৪৫ কোটি টাকা, আর অযাচিত বিল, অতিরিক্ত সম্মানী, আয়কর কর্তন না করা, অগ্রিম সমন্বয় না করাসহ নানা কারণ দেখিয়ে আরও প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। এতে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোয় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বছরও বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর তদবির, সক্রিয় প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেট, মানহীন ২০ হাজার পাঠ্যবই বাতিল, এক ছাপাখানাকে সতর্ক করে দরপত্রের শর্ত পূরণের নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১০ সাল থেকে বিনা মূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করছে সরকার। মূলত তখন থেকে নিউজপ্রিন্টে নিম্নমানের বই ছাপা শুরু হয়। তবে ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বই ছাপায় বড় অনিয়ম করা হয়। টেন্ডারের সব শর্ত মেনে পাঠ্যবই ছাপার ঠিকাদারি নিলেও কাগজের পুরুত্ব, উজ্জ্বলতা ও টেকসই ক্ষমতা (বার্স্টিং ফ্যাক্টর) কিছুই মানা হয়নি। তার পরও ছাপাখানাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি তৎকালীন কর্তৃপক্ষ। ২০২৩ সালের মতো গত ১১ বছরও গড়ে ২৫০ কোটি টাকার মতো লুটপাট করা হয়েছে। সেই হিসাবে গত এক যুগে বিনা মূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি লোপাট হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৪০ কোটি ১৪ লাখ ৯৫ হাজার ৮৪১টি পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ চলমান। তবে এবার সময়মতো পাঠ্যবই ছাপানোর সময় মানের ক্ষেত্রে আপস না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
গতবারের চেয়ে এবার কাগজের পুরুত্ব ও উজ্জ্বলতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত বছর কাগজের পুরুত্ব ছিল ৭০, আর উজ্জ্বলতা ছিল ৮০। এ বছর কাগজের পুরুত্ব ৮০ এবং উজ্জ্বলতা ৮৫ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বার্স্টিং ফ্যাক্টর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ১৬।
সূত্র জানায়, এনসিটিবি বলে দিয়েছে, ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হবে। যদি কোনো ছাপাখানা এর ব্যত্যয় করে কিংবা বইয়ের মান ঠিক না থাকে, তাহলে ডিপিএমের (ডিরেক্ট পারচেজ ম্যানেজমেন্ট) মাধ্যমে আর্মি প্রিন্টিং প্রেস বই ছাপিয়ে বই সরবরাহ করবে।
অভিযোগ উঠেছে, টেন্ডারের সব শর্ত মেনে পাঠ্যবই ছাপার ঠিকাদারি নিলেও, এবারও কাগজের টেকসই ক্ষমতা (বার্স্টিং ফ্যাক্টর) কমানোর অপচেষ্টা করছেন একশ্রেণির মুদ্রাকর। বেশি মুনাফার লোভে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে চাপ দিয়ে বার্স্টিং ফ্যাক্টর ১৬ থেকে নামিয়ে ১০ করতে চান তারা।
জানা গেছে, বইয়ে ব্যবহৃত কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমাতে পারলে শত কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা হবে। এ কারণে কমানোর তদবিরে কিছু ছাপাখানার মালিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, কাগজের তিনটা প্যারামিটার অতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, কাগজটা কত পুরু বা মোটা। তারপর ব্রাইটনেস মানে উজ্জ্বলতা। তৃতীয় হলো বার্স্টিং ফ্যাক্টর বা কাগজের শক্তি। যেটা কম হলে কাগজ দুর্বল হবে। বইয়ের পাতা তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে যাবে। বইয়ের গুণমান খারাপ হবে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এবার আমরা বইয়ের মানের ক্ষেত্রে কোনো কম্প্রোমাইজ করব না। টেন্ডারে উল্লেখিত সব শর্ত মেনে বই ছাপানোর ঠিকাদারি পেয়েছে তারা। কার্যাদেশ পাওয়ার পর বই ছাপা শুরু করেছে। কিন্তু বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর দাবি পুরোপুরি অযৌক্তিক। এসব দাবি মানা সম্ভব নয় কোনোভাবেই।
বার্স্টিং ফ্যাক্টর ১৬ থেকে নামিয়ে ১০ করার জন্য এনসিটিভিকে চাপ দিয়েছেন ঠিকাদার, এ বিষয়ে তিনি বলেন, তারা এসেছিল। তাদের বলে দেওয়া হয়েছে টেন্ডারের সব শর্ত মেনে কাজ করতে হবে। এরপর আমাদের সঙ্গে এসব বিষয়ে বলার মতো সাহস তাদের আর হবে না।
তবু মানের ব্যত্যয় হলে বিকল্প ব্যবস্থা কী হবে, এমন প্রশ্নে চেয়ারম্যান বলেন, সে ক্ষেত্রে বইয়ের মান খারাপ হলে তাদের জরিমানা করা হবে এবং তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। এ বিষয়ে জোরালো হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। ১ জানুয়ারি বই দেওয়া আমাদের কর্তব্য। মানের ব্যাপারে কতটুকু আপসযোগ্য হবে, তখন গণমাধ্যমও দেখবে বিষয়টা।
আর্মি প্রিন্টিং প্রেসের সক্ষমতা নিয়ে ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, আনন্দ পিন্টার্স শর্ত পূরণ না করলে আর্মিকে কাজ দিতে সমস্যা নেই। তবে তাদের কতটুকু সক্ষমতা আছে, সেটাও প্রশ্ন থেকে যায়। যদিও আমি আর্মিকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেছি। দেখা যাক পরিস্থিতি কী হয়।