কুমিল্লা মুরাদনগরের কোটি টাকার ভূমি কর্তা !
ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা পূর্ব ইউনিয়ন উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম (৩৫) আহামরি বেতন পান না। তবে থাকেন কুমিল্লা জেলা শহরে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। শফিক ও তাঁর স্ত্রীর নামে স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।
শফিকুল উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার চাপুর গ্রামের শাহজাহান ওরফে শুকুর আলীর ছেলে। তিনি ছয়টি সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক। একটি সার্বক্ষণিক ব্যবহার করেন, বাকি পাঁচটি ভাড়ায় চলে। বাখরনগরে তাঁর স্ত্রীর নামে ৩৭ শতাংশ জমি আছে। যার দাম প্রায় ৭০ লাখ টাকা। কুমিল্লার দুর্গাপুর খেতাশায় পাঁচ শতাংশ জায়গা আছে। এর দাম ৫০ লাখ টাকা।
শফিকুল মাসে তিন থেকে চার দিন অফিস করেন। অন্য আরো ২১টি ইউনিয়ন ভূমি সহকারীরা তাঁকে মাসোয়ারা দেন, যাতে কোনো ঝক্কি-ঝামেলায় না পড়তে হয়। খাল ভরাট, খাসজমি দখলে সহায়তা, জমাখারিজ করে দেওয়ার নামে লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ শফিকের নানা অনিয়ম এখন মানুষের মুখে মুখে। গ্রাহকদের নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সহকারী কমিশনার ভূমি (এসি ল্যান্ড) তাঁকে কারণ দর্শাতে (শোকজ) বলেন চারবার। শোকজের এক মাস পর এসি ল্যান্ড রাশেদা আক্তার বদলি হয়ে যান অন্যত্র। নতুন এসি ল্যান্ড আসার আগে শফিক তাঁর ব্যক্তিগত অফিস ফাইল থেকে শোকজের কাগজ সরিয়ে ফেলেন। তাঁর এই দাপটের কারণ হিসেবে তিনি প্রচার করেন, এক আত্মীয় মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ৫ অক্টোবর এসি ল্যান্ড রাশেদা আক্তার বদলি হলে ৬ অক্টোবর থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাসেলুল কাদের ভূমি অফিসের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। এই চার মাস ভূমি অফিসের সব জমাখারিজ শফিকের হাত হয়ে ইউএনওর টেবিলে যেত। যার ফলে শফিক উপজেলার একটি ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকলেও অন্য আরো ২১ ইউনিয়নের জমাখারিজ করে দেওয়ার কাজ হাতে নেন। বিনিময়ে তিনি অন্তত তিন শ লোকের কাছ থেকে ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেন। এদের মধ্যে অনেকের কাজ করে দিলেও ১৮৯টি খারিজ আটকে যায়। আটকে যাওয়া গ্রাহকরা শফিককে বিভিন্নভাবে হুমকিধমকি দেয়, কেউ আবার ভূমি অফিসে এসে তাঁর নামে অভিযোগ করে। পরে ভূমি অফিসের লোকজন ১৮৯ জনের সঙ্গে সমঝোতা করে দেওয়ার দায়িত্ব দেয় সদর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ছগির আহমেদকে।
এ বিষয়ে ছগির আহমেদ বলেন, ‘১৮৯ জন লোকের মধ্যে প্রায় অধিকাংশ লোকের সঙ্গে শফিকের সমঝোতা করে দিয়েছি। বাকিগুলো কিছু দিনের মধ্যে শেষ হবে যাবে।’
রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামের মন্টু মিয়া বলেন, ‘শফিক আমার দুইটা ভিপি জমি খারিজের জন্য ১৪ হাজার টাকা নেয়। এ দুটি কাজ করে দেওয়ার পর তাকে আরো চারটি জমির খারিজ করতে দিই। কাগজপত্রে কোনো সমস্যা নেই, বিধায় চারটি খারিজের জন্য ১২ হাজার টাকা নেয় সে; কিন্তু এ কাজগুলো করতে পারেনি। এখন ছগির চার হাজার টাকা ফেরত দিয়ে আবার নতুন করে কাগজপত্র জমা দিতে বলেছে।’
গত ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় বাঙ্গরা পূর্ব ইউনিয়নের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের অফিসে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে পাওয়া যায় অফিস সহায়ক কামাল হোসেনকে। কামালের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাঙ্গরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাবুল। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ির খাজনা নিয়ে জটিলতা থাকায় গত পনের দিনে সাতবার অফিসে এসে শফিককে পাইনি। অনেকবার ভূমি অফিসে ফোনে অভিযোগ করেছি, কোনো কাজ হয়নি। সে নাকি অনেক ক্ষমতাধর লোক।’
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় গিয়ে দেখা মেলে মোখলেছপুর গ্রামের শহিদুল ইসলামের (৭২) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ছেলেরা বাইরে থাকে। তাই নিজের জমির খাজনা পরিশোধ করার জন্য বেশ কয়েক দিন এসেছি। বুড়া বয়সে বারবার আসতে কষ্ট হয়।’ দুপুর ১২টায় অফিসে আসেন খাজনা দিতে বাঙ্গরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিমের ছোট ভাই আব্দুল মজিদ (৬৪)। তিনি ঢাকা থেকে এসেছেন। খাজনা দিয়ে আবার ফিরে যাবেন। দুপুর ২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কর্মকর্তাকে না পেয়ে চলে যান।
শফিকের অফিসে সাংবাদিক এসেছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে পাওনাদাররা ছুটে আসেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কাঁচামালের দোকানদার শফিক, চায়ের দোকানদার মোমেন, তরকারি ব্যবসায়ী মালেক, ব্যবসায়ী মাওলানা শফিক। তাঁরা ভূমি কর্মকর্তার কাছে পাঁচ হাজার টাকা করে পান। জমির জমাখারিজ করার জন্য এ টাকা দিয়েছিলেন।
বাঙ্গরা গ্রামের শেখ আলমগীর বলেন, ‘আমার কাছ থেকে ছয় হাজার টাকা নিয়েছেন জমির খারিজ করে দেওয়ার জন্য।’ তিনি জানান, খামার গ্রামের আব্দুল সামাদ মিয়ার ছেলে মানিক তাঁকে উপস্থিত রেখে জমির খারিজ করার জন্য ২০ হাজার টাকা দেয় শফিককে। কাজ হয়নি বা টাকাও ফেরত পায়নি।
৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সাম মিয়া বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে ভূমি অফিস। কর্মকর্তা শফিকের কাছে আমিও পাঁচ হাজার টাকা পাই। শুধু আমি না, কয়েক শ লোক তার কাছে টাকা পায়।’
বাঙ্গরা ৬ নম্বর পূর্ব ইউপির চেয়ারম্যান মান্নান বলেন, ‘আমার ইউনিয়ন পরিষদের ভবনের দোতলায় ভূমি কর্মকর্তার অফিস। সকাল-বিকাল তার ব্যাপারে অভিযোগ শুনতে শুনতে আমি অস্থির। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে এখন সে অফিসে আসে না। প্রায় ওই অফিসে শোরগোল শোনা যায়। বেশি মাত্রায় হৈচৈ হলে আমার অফিসের চকিদাররা গিয়ে নিবৃত করেন। তার নির্দিষ্ট কয়েকজন দালাল আছে তাদের ফোন ছাড়া অন্য কারো ফোন রিসিভ করে না শফিক। শুনেছি সে নাকি সব সময় নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করে।’
অভিযুক্ত শফিকুর রহমান মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমার বেশ কিছু শত্রু আছে। ওই এলাকায় তারা আমার বিরুদ্ধে নানা অপকথা ছড়ায়।’ আপনি গত ১৫ দিনে এক দিন অফিস করেছেন। বাকি দিনগুলো কোথায় ছিলেন? এমন প্রশ্নে বলেন, ‘আমি অসুস্থ।’ চিকিৎসা ছুটি নিয়েছেন? প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘নৈমিত্তিক ছুটি নিছি তিন দিন।’
মুরাদনগর উপজেলার এসি ল্যান্ড রায়হান মেহেবুব বলেন, ‘অল্প কিছুদিন হলো এসেছি। তার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘অনিয়মের সত্যতা তদন্ত করে প্রমাণিত হলে বিধি মোতাবেক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ