ডিসেম্বরে খুলছে ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কের তিন সেতু
ডেস্ক রিপোর্টঃ ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়কে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সেতুর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। সেতু তিনটি হচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর দ্বিতীয় কাঁচপুর, দ্বিতীয় মেঘনা এবং দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতী সেতু। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারলেনের এই সেতু তিনটির নির্মাণকাজের অগ্রগতি সম্পর্কে সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছেন। তাঁর নির্দেশনায় তিনটি সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রগতি দেখতে প্রায়ই ছুটে যান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সে কারণে খুব দ্রুত এগিয়ে চলছে সেতু তিনটির নির্মাণকাজ।
সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী, আগামী ডিসেম্বরেই এগুলো যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। এরপর বছরজুড়ে চলবে পুরনো তিন সেতুর সংস্কারের কাজ। নতুন সেতু তিনটি নির্মাণ ও পুরনোগুলোর সংস্কার শেষ হলে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার দূরত্বের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচল অনেকটাই নির্বিঘ্ন হবে। বন্দর নগরীর সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দ্রুত কাজ চলায় এই তিন সেতু নির্মাণে ব্যয়ও কমবে অন্তত ৭শ’ কোটি টাকা। এই তিনটি সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪শ’ ৮৬ কোটি ৯৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু মহাসড়কের উপরে সেতু তিনটি দুই লেনের। এ কারণে এই তিন সেতুতে যানজট লেগেই থাকে। সর্বোপরী সেতুগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। এ তিন সেতুর দুই পাশেই প্রতিদিন গাড়ির দীর্ঘ লাইন তৈরী হয়। চার লেনের সড়ক থেকে হঠাৎ করেই সেতুর মুখে এসে গাড়িগুলোকে এক লেনে চলতে গিয়ে এমন যানজটের সৃষ্টি হয়।
সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে ঠিকাদারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে সড়ক বিভাগ। ২০১৬ সালে তিন সেতু নির্মাণের দৃশ্যমান কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত কাজের মেয়াদকাল হলেও তিনটি সেতুরই কাজ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে। একই সঙ্গে বিদ্যমান সেতু তিনটির পুনর্বাসন কাজও শুরু হবে।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে নতুন তিনটি সেতুর মধ্যে দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতুর মূল অ্যাবাটমেন্ট ১ ও ২ এবং সব পিলারের ফাউন্ডেশন নির্মাণ শেষ হয়েছে। অ্যাবাটমেন্ট ১ এবং ১ নম্বর পিলারের হেড নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে ৬৪টি বক্স গার্ডার সেট ও ডেক স্ল্যাব প্যানেলও এ সেতুর সুপারস্ট্রাকচার বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে এ সেতুর চট্টগ্রাম অংশের সংযোগ সড়ক, ডাইভারশন সড়কসহ অন্যান্য কাজ শেষ হয়েছে। শুধু সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনকারী ওভারপাসের পাইলিং নির্মাণের কাজ চলছে।
চারলেনবিশিষ্ট এ সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে বিদ্যমান সেতুর ভাটিতে। ৩৯৭ দশমিক ৩ মিটার দীর্ঘ এ সেতুর সংযোগ সড়ক হবে আটলেনবিশিষ্ট। আর বিদ্যমান সেতু ও নতুন সেতু মিলিয়ে লেনও হবে আটটি।
চারলেনবিশিষ্ট দ্বিতীয় মেঘনা সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে বিদ্যমান সেতুর উজানে। ৯৩০ মিটার দীর্ঘ এ সেতুটির উভয় পাশে থাকবে ছয়লেনবিশিষ্ট সংযোগ সড়ক। আর বিদ্যমান ও নতুন সেতু মিলিয়ে সেতু হবে ছয় লেনের। ইতিমধ্যে এ সেতুর মূল অ্যাবাটমেন্ট ১ ও ২ এবং ১ থেকে ৪ এবং ৮ থেকে ১১ নম্বর পিলারের ফাউন্ডেশনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। অ্যাবাটমেন্ট ১ ও ২ এবং তিনটি পিলারের হেড নির্মাণের কাজও শেষ। এ সেতুর জন্য ভিয়েতনাম থেকে ১০৮টি বক্স গার্ডার, ৭২টি ক্রস গার্ডার এবং ২১৬টি ডেক স্ল্যাব ইতিমধ্যে প্রকল্প এলাকায় চলে এসেছে।
অন্যদিকে, দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতী সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে বিদ্যমান সেতুর ভাটিতে। এ সেতুটিও হবে চার লেনের। আর পুরনো ও নতুন সেতু মিলিয়ে হবে ছয় লেন। এক হাজার ৪১০ মিটার দীর্ঘ এ সেতুর মূল অ্যাবাটমেন্ট ১ ও ২ এবং ১ থকে ৪, ১১ থেকে ১৬ নম্বর পিলারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ১৫ ও ১৬ নম্বর পিলারের হেড নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে। এ সেতুর জন্য মিয়ানমার থেকে ১৪৪টি বক্স গার্ডার ও ২৩৬টি ডেক স্ল্যাব প্যানেল প্রকল্প সেতুর সুপারস্ট্রাকচার বসানোর কাজ শুরু হয়েছে।
দ্বিতীয় কাঁচপুর, মেঘনা এবং মেঘনা-গোমতী সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (জাইকা) আর্থিক সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে। তিনটি সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৪৮৬ কোটি ৯৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে জাইকার প্রকল্প সাহায্য রয়েছে ৬ হাজার ৪২৯ দশমিক ২৮৯৬ কোটি টাকা। সরকারি তহবিল থেকে জোগান আসবে ২ হাজার ৫৭ দশমিক ৬৪৮৭ কোটি টাকা। জাইকার অর্থ সেতুগুলোর নির্মাণ, পুনর্বাসন ও পরামর্শ সংক্রান্ত কাজে ব্যয় হবে। ভ্যাট, ট্যাক্সসহ প্রশাসনিক ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত ব্যয় নির্বাহ হবে সরকারি তহবিল থেকে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, নির্ধারিত সময়ের আগে সেতু তিনটির নির্মাণকাজ শেষ হলে প্রাক্কলিত ব্যয় থেকে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। সেতু তিনটি যৌথভাবে নির্মাণ করছে জাপানি প্রতিষ্ঠান ওবায়শি করপোরেশন, সিমিজু করপোরেশন এবং জেএফই ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত গতিতে কাজ করার ফলে নির্ধারিত সময়ের আগেই সেতু নির্মাণ শেষ হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঝুঁকির মুখে থাকা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিদ্যমান তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুর পাশেই আরও তিনটি সেতু নির্মাণের লক্ষ্যে ২০১৩ সাল থেকে কাজ শুরু করে সরকার। একসঙ্গে তিনটি সেতু নির্মাণ এবং পুরনো তিনটি সেতু পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে ধরে ২০২১ সালের অক্টোবরের মধ্যে সেতুগুলো নির্মাণের সময়কাল ধরা হয়। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে ঠিকাদারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে সড়ক বিভাগ। ২০১৬ সালে তিন সেতু নির্মাণের দৃশ্যমান কাজ শুরু হয়।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, মূলত পাঁচটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ‘কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতি দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ’ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এগুলো হলো, ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কে ক্রমবর্ধমান যানবাহনের সংকুলান করা, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করা, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধন করা, প্রকল্প এলাকায় আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড উন্নত করা এবং সকলের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তিনটি সেতরু নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে বর্তমান সেতুগুলোর মেরামত কাজে হাত দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এই তিনটি সেতুর মেরামতেও অন্তত এক বছর সময় লাগতে পারে। সংশ্লিষ্টরা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, পুরোনো তিন সেতু মেরামতের পর নতুন তিনটির সঙ্গে যান চলাচলে যুক্ত হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যোগাযোগব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। কমে যাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময়। বর্তমানে তিন সেতুতে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা সময় বেশি লাগে। সেই সময় অনায়াসে কমে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়া যাবে।
সূত্রঃ ইনকিলাব