কুমিল্লার মাতৃ ভান্ডারে ঘণ্টায় বিক্রি দেড়শ কেজি
নজরুল ইসলাম দুলালঃ কুমিল্লার রসমালাই। দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী যার চাহিদা। কুমিল্লার যত খ্যাতি তার সঙ্গে খাদি বস্ত্রের পাশাপাশি চলে আসে রসমালাইয়ের নাম। কুমিল্লায় এলেন তো মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই না নিয়ে ফেরার মানেই হয় না।
কী এমন রহস্য যে ভোর থেকে লাইন দিয়ে রসমালাই কিনতে হবে? এমনই চাহিদা যে এ ঘণ্টায় শত কেজির রসমালাই শেষ। অথচ পাশেই আছে আরো দুটি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। একটি ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার। আরেকটি শিতল ভাণ্ডার। কিন্তু সব আকর্ষণ মাতৃভাণ্ডারের দিকে। অথচ রসমালাই বিক্রিতে এই ৩ প্রতিষ্ঠানই খ্যাত। ভোর ৬টা থেকেই মাতৃভাণ্ডারে ক্রেতার ভিড়। যখন কুমিল্লার সব দোকানপাঠ থাকে বন্ধ। অন্য দুটি দোকানে ক্রেতা নেই। কিন্তু মাতৃভাণ্ডারে এ ঘণ্টায় রসমালাইয়ের ভাণ্ডার শেষ। আবার নতুন করে তৈরি করে দুপুরে বিক্রি শুরু হয়। দিনে রাতে মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই বিক্রি হয় প্রায় ৬ থেকে ৭শ’ কেজি।
ক্রেতারা জানান, স্বাদে-গন্ধে ও মানে মাতৃভাণ্ডারই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু দেশের কোথাও এর শাখা নেই। তারপরও কুমিল্লার সর্বত্র মাতৃভাণ্ডারের নামে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। যার সবই নকল রসমালাই। এতে ক্রেতারা প্রতিনিয়ত হচ্ছেন প্রতারণার শিকার। রসমালাইয়ের উদ্ভাবক মাতৃভাণ্ডারের নামের সামনে-পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল করে ‘কুমিল্লা’, ‘কুমিল্লার’ ইত্যাদি নাম ব্যবহার করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার থেকে আলেখারচর পর্যন্ত, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অসংখ্য মিষ্টির দোকান রয়েছে। দোকানগুলোর সাইনবোর্ডে কোনোটিতে লেখা আছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত’, কোনোটিতে লেখা ‘আমাদের একমাত্র শাখা এটি’। তারা নষ্ট করছে ঐতিহ্য ও কুমিল্লার আসল ও অতুলনীয় স্বাদের রসমালাইয়ের সুনাম। এছাড়া রাজধানী ঢাকায় যেসব রসমালাই বিক্রি হয় কুমিল্লার রসমালাই নামে, তার বেশিরভাগই নকল। মাতৃভাণ্ডারের খাটি রসমালাই নামে যা বিক্রি হয় তার সঙ্গে আসল রসমালাইয়ের স্বাদ, গন্ধ ও ঘনত্বে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
১৯৩০ সাল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খড়িয়ালার খনিন্দ্র সেন ও মণিন্দ্র সেন নামে দুই ভাই কুমিল্লায় আসেন। ওই সময় শহরের মনোহরপুর এলাকায় মাতৃভাণ্ডার নামে একটি দোকান দিয়ে ক্ষীরভোগ বা রসমালাই বিক্রি শুরু করেন। সেই থেকে কুমিল্লায় রসমালাইয়ের খ্যাতি লাভ করতে থাকে। তার বড় ছেলে শংকর সেনগুপ্ত আজও তার পৈতৃক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। মূলত কুমিল্লার ঘোষ সম্প্রদায় দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর বানিয়ে তাতে ছোট আকারের শুকনো রসগোল্লা ভিজিয়ে যে মিষ্টান্ন তৈরি করে, তা ক্ষীরভোগ নামে পরিচিতি পায়। ক্রমান্বয়ে এই ক্ষীরভোগ রসমালাই নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৯৩০ সালে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরে মাতৃভাণ্ডার নামে দোকানে এ রসমালাই বিক্রি শুরু হয়। খনিন্দ্র সেন ও মণিন্দ্র সেন নামের দুই ভাই রসমলাই তৈরি করে বিক্রি শুরু করেন। বর্তমানে এ মাতৃভাণ্ডার পরিচালনা করেন শংকর সেন। সুস্বাদু আর ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টান্নের যাত্রা শুরু হয়েছিল কুমিল্লা থেকেই। আসল মাতৃভাণ্ডার ছাড়া কুমিল্লার রসমালাই পাওয়া যাবে ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার, শীতল ভাণ্ডার, পোড়াবাড়ি, জলযোগসহ কয়েকটি মিষ্টির দোকানেও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী রসমালাই তৈরির প্রক্রিয়া খুবই সহজ। একটি পাতিলে বা করাইয়ে এক মণ দুধ দুই ঘণ্টা ধরে জ্বাল দিলে তা ঘন হয়ে ১৩-১৪ কেজি ক্ষীর তৈরি হয়। এর দুধ থেকে পাওয়া ছানার সঙ্গে কিছু ময়দা দিয়ে খামির তৈরি করে বানানো হয় ছোট ছোট গুলি বা রসগোল্লা। এক মণ দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন ক্ষীর তৈরি করে তাতে ছোট গুটি বা শুকনো রসগোল্লা দিয়ে ১৪ কেজির মতো রসমালাই বানানো যায়। অপর দিকে রসমালাই তৈরির কয়েকজন কারিগর জানান, অনেক অসাধু ব্যবসায়ী গরুর আসল দুধ ব্যবহারই করে না। তা ছাড়া যে ছানা দিয়ে রসমালাইয়ের গুটি বানানো হয় তাতে এক কেজি ছানাতে এক ছটাক পরিমাণ ময়দার স্থলে এক পোয়া ময়দা মেশানো হয়। কিন্তু এতে রসমালাইয়ের সত্যিকারের স্বাদ থাকে না। কুমিল্লার মনোহরপুরের রাজরাজেশ্বরী কালীমন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে তিনটি মিষ্টির দোকান। এদের মধ্যে রসমালাইয়ের জন্য বিখ্যাত মাতৃভাণ্ডার, ভগবতি পেড়া ভাণ্ডার আর শীতল ভাণ্ডার। অ্যাডভোকেট কিরণময় দত্ত ঝুনুর ভগবতি পেড়া ভাণ্ডারের রসমালাই মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের মতোই সুস্বাধু। মাতৃভাণ্ডারের পরই রয়েছে ভগবতি পেড়া ভাণ্ডারের স্থান। তবে প্রতিদিন কী পরিমাণ রসমালাই বা মিষ্টান্ন উৎপাদন করা হয় বা কত টাকার মিষ্টান্ন বিক্রি করা হয়ে থাকে এ বিষয়ে মাতৃভাণ্ডারের পরিচালক শংকর সেনগুপ্ত ও ব্যবস্থাপক অনির্বাণ সেনগুপ্ত মুখ খুলতে নারাজ। এ বিষয়ে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাদের কাছ থেকে কিছু জানা যায়নি। ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার ও শীতল ভাণ্ডার কর্তৃপক্ষও তাদের উৎপাদন ও বিক্রির তথ্য না জানিয়ে অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে সূত্র জানায়, প্রতিদিন দুই দফায় (সকালে ও বিকালে) মাতৃভাণ্ডারে ৪৫ থেকে ৫০ মণ দুধ পাইকাররা সরবরাহ করে থাকে। ওই হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ৭ থেকে ৮শ কেজি রসমালাই উৎপাদন ও বিক্রি হয়ে থাকে প্রায় পৌনে ২ লাখ টাকা থেকে ২ লাখ টাকা। প্রতিদিন ভোর থেকে প্রায় সারা দিন ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে কুমিল্লার এই মাতৃভাণ্ডারে। এছাড়া বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে জেলা ও জেলার বাইরে থেকে ক্রেতারা অর্ডার দিয়ে এক মণ বা চাহিদানুযায়ী আরও বেশি পরিমাণ রসমালাই গাড়িতে করে নিয়ে থাকেন।
সূত্রঃ যুগান্তর