কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে বেপরোয়া ঘুষবাণিজ্য
নয়া দিগন্তঃ দেশের বেশির ভাগ কারাগারে কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো নীরবে চলছে অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটের ঘটনা। এ ক্ষেত্রে কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার। এ কারাগারে আসামির সাথে স্বজনেরা দেখা করতে গেলেই কারারক্ষীদের নিয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের সদস্যরা ঘিরে ধরেন। মুখোমুখি দেখা করিয়ে তারা প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। শুধু দেখা সাক্ষাতে ঘুষবাণিজ্য হচ্ছে তা নয়, কারাগারের ভেতরেও চলছে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি। এমন অভিযোগ কারাগারে বন্দীর সাথে দেখা করতে আসা স্বজনদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একজন বন্দীকে কারাগারের হাসপাতাল ও সেলে আরাম আয়েশে থাকতে হলে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ (৪০০০-৬০০০ টাকা) গুনতে হয়। জামিনেও রয়েছে নিয়ম। তা ছাড়া বন্দীদের সরকারি বরাদ্দের যে খাবার প্রতিদিন দেয়া হচ্ছে তার মান খুব খারাপ। মোট কথা বন্দীদের নিয়ে কারা প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা- কর্মচারী রীতিমতো বাণিজ্য করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি কুমিল্লা জেলা কেন্দ্রীয় কারাগারে সরেজমিন খোঁজ নিতে গেলে সেখানে আটক বন্দীর স্বজন ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
১৮ অক্টোবর বেলা ১১টা। কারাগারের গেট থেকে এক যুবক তার মাকে নিয়ে বের হচ্ছিলেন। তারা রিকশায় ওঠার আগেই এ প্রতিবেদক পরিচয় গোপন রেখে কারাগারে আসামিদের ভালোভাবে থাকার জন্য কী করতে হয় জানতে চাইলে মহিলা বলেন, আমার স্বামী প্রায় চার মাস ধরে এ কারাগারে। তাকে মাদকের একটি মামলায় কোতোয়ালি থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। স্বামী যাতে কারাগারে ভালো থাকে সে জন্য বেড ভাড়ার বাবদ প্রতি মাসে চার হাজার টাকা ভেতরে পাঠাচ্ছি। কার মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারারক্ষী আখতার হাসপাতালে এক ডাক্তারের প্রতিনিধি। বাইরেই তাকে পাওয়া যায়।
মহিলা আমার কাছে জানতে চান আমি কোথা থেকে এসেছি। ঢাকা থেকে বলার পর তিনি বলেন, ঢাকা থেকে এসেছেন, পরিচয় দিলে আপনার কাছ থেকে কিন্তু প্রতি মাসে ছয় হাজার টাকা দাবি করবে? তিনি কারাগারের ভেতরের কিছু তথ্য জানিয়ে বলেন, আমার স্বামী গত চার মাসে কখনো থাকার কষ্টের কথা বলেননি। তবে খাবারের মান খুব খারাপ বলে জানিয়েছেন। তবে ভেতরের কারা ক্যান্টিন থেকে পিসির মাধ্যমে দাম দিয়ে ভালো খাবার কিনে খেতে পারছেন।
সরাসরি দেখা করার নিয়ম আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে অফিস কলে দেখা করলে ৫০০-৬০০ টাকা লাগে। আর্জেন্ট কল ১০০ টাকা। দেখা করতে চাইলে গেটে গেলেই আপনাকে তারা ডাকবে। মহিলার কথামতো কারাগারের মূল গেটে প্রবেশ করা মাত্রই কর্তব্যরত কারারক্ষী মো: সুজন মিয়া জানতে চান, আপনি কি কারো সাথে দেখা করতে এসেছেন? আমি আপনাকে মুখোমুখি দেখা করিয়ে দিতে পারব। ১৫ মিনিটের জন্য ৬০০ টাকা লাগবে।
তার কথা শেষ না হতেই সিভিল পোশাকে আরেক কারারক্ষী এসে বলতে থাকেন, ৬০০ টাকার স্লিপ কাটেন, এখনই আপনাকে দেখা করিয়ে দেবো। এ সময় কারাগারের গেটের বাম পাশের জানালায় কর্তব্যরত কারারক্ষী উত্তম ৬০০ টাকার স্লিপ কাটতে বলেন। তখন তাকে টাকা কমানোর প্রস্তাব দিলে তিনি ৫০ টাকা কম দেয়ার অনুরোধ করেন। যার ভিডিও তথ্য এ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। এ সময় প্রতিবেদক ভেতরে কারা-ক্যান্টিনে ঢুকতে গেলে গেটে থাকা সুজন মিয়া এ প্রতিবেদককে অনুরোধ করেন, দেখাটা যেন তার মাধ্যমেই করানো হয়।
কারা ক্যান্টিনে গেলে সেখানে কর্তব্যরত সুবেদারসহ অন্য কারারক্ষীরা বন্দীর সাথে আসামির দেখা করানো নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এ সময় সুবেদার সোহাগ কারারক্ষীদের উদ্দেশ বলতে থাকেন, আসামির সাথে তোমরা যত পারো দেখা করাও, কিন্তু রেট কমাইও না। রেট কমাইলে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা হয়। রেট ৬০০ টাকাই থাকবে। এ সময় এক কারারক্ষী প্রতিবেদকের পরিচয় জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন।
গতকাল চট্টগ্রাম বিভাগের ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বণিকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। এর আগে ‘কারাগারে বেপরোয়া ঘুষবাণিজ্য’-এর অভিযোগ প্রসঙ্গে গতকাল শুক্রবার কুমিল্লা কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহানারা বেগমের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি খুব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। তাই কোনো কথা বলতে পারছি না।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিভাগে মোট ১১টি কারাগার আছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা কারাগার দু’টি হচ্ছে কেন্দ্রীয় কারাগার। অন্য ৯টি জেলা কারাগার। এই বিভাগে মোট বন্দীর সংখ্যা ৬ হাজার ২৪ জন। কিন্তু কুমিল্লা কারাগারে কত বন্দী আছে তা জানা যায়নি। কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের মোট জমির পরিমাণ ৬৮ একর। কারাগারের বাইরে ৩৬ একর এবং ভেতরে রয়েছে ৩২ একর।