সেন্ট্রালের আগে কুমিল্লার হাসপাতালে কী হয়েছিল আঁখির সঙ্গে?
রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতারণা ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগে ১০ জুন মারা যায় ইয়াকুব আলী ও মাহবুবা রহমান আঁখির নবজাতক সন্তান। সন্তান জন্মদানের সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভুলের অভিযোগে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়া মাহবুবা রহমান আঁখিকে ১০ জুন ল্যাবএইড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে ১৮ জুন মাহবুবা রহমান আঁখি মৃত্যুবরণ করেন।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী হিসেবে ইয়াকুব আলী প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ডা. সংযুক্তা সাহার বিপক্ষে। ১৫ জুন ধানমন্ডি থানায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’র একটি মামলা করার পাশাপাশি অভিযোগ জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলেও (বিএমডিসি)।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে যে প্রশ্ন উঠে এসেছে তা হলো, কুমিল্লা থেকে কিভাবে সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এলো মাহবুবা রহমান আঁখি? কুমিল্লায় কী তবে কোনো চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব ছিল না? মাহবুবা রহমান আঁখি কী কুমিল্লায় স্থানীয় কোনো চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন? লেবার পেইন ওঠার পরেও কিভাবে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন মাহবুবা রহমান আঁখি? কী ছিল তাহলে কুমিল্লায় স্থানীয় চিকিৎসকদের ভূমিকা?
এ সব প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করা হয়। আর তাই কুমিল্লার তিনটি উপজেলা সরেজমিনে ঘুরে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
বছরতিনেক আগে নাঙ্গলকোট উপজেলায় বাড়ী ইয়াকুব আলী সুমনের সঙ্গে বিয়ে হয় লাকসাম উপজেলার পূর্ব ইউনিয়ন গাইনেরডহরা গ্রামের মাহবুবা রহমান আঁখির। ইয়াকুব আলী সুমন সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন তিতাস উপজেলার বাতাকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ে। মাহবুবার রহমান আঁখি রাজধানীর ইডেন কলেজের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। অনার্সের রেজাল্ট ছিল ৩ দশমিক ২৮।
ইয়াকুব আলী বলেন, ‘ওর অনার্স পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেই মূলত আমরা বাচ্চা পরিকল্পনা করি। আঁখি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবসময় ডা. সংযুক্তা সাহাকে ফলো করতেন। আর তাই গর্ভধারণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার আগে ও পরে সবসময় নিজেই সবকিছু সংযুক্তা ম্যাডামের পেইজ ফলো করতেন। সেভাবেই মূলত সবকিছু পরিকল্পনা করা হয়।’
গর্ভধারণের পরে আঁখির প্রথম ছয় মাসের ফলোআপ যেভাবে হয়
২৪ বছর বয়সী মাহবুবা রহমান আঁখি গর্ভধারণের পরে প্রথম চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে যান কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুরের দেশ হসপিটাল লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ২১ অক্টোবর সেখানে ডা. সুষ্মিতা বর্ধ্বনের পরামর্শ নেন মাহবুবা রহমান আঁখি। ডা. সুষ্মিতা বর্ধ্বন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একজন স্ত্রী রোগ প্রসূতি বিদ্যা ও গাইনী ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ সার্জন।
এদিন মাহবুবা আক্তার আঁখির বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিষয়ে লেখা হয় প্রেসক্রিপশনে। দেড় মাসের গর্ভবতী মাহবুবা রহমান আঁখিকে সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ জানানো হয় ২০২৩ সালের ১৩ জুন। এদিন তার ওজন পাওয়া যায় ৫৭ কেজি ও রক্তচাপ ছিল ১০০/৬০। এসব বিবেচনায় নিয়ে তাকে প্রেসক্রিপশন দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে তিতাস থেকে লাকসাম বাবার বাড়িতে গেলে সেখানে ফলোআপ চিকিৎসার জন্য যান লাকসাম জেনারেল হসপিটাল (প্রা.) লি. নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। সেখানে ডা. লতিফা আহমেদের (লতা) চেম্বারে চিকিৎসা পরামর্শ নেন মাহবুবা রহমান আঁখি। এ দিন তার ওজন ছিল ৬০ কেজি ও রক্তচাপ মাত্রা ছিল ১১০/৭০। সাড়ে তিন মাস গর্ভাবস্থায় মাহবুবা রহমান আঁখির বিভিন্ন রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক চিকিৎসা পরামর্শ লিখে দেন প্রেসক্রিপশনে।
এরপরে আর এই দুই চিকিৎসকের কাছে অবশ্য চিকিৎসা ফলোআপের জন্য যাওয়া হয়নি মাহবুবা রহমান আঁখির।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচারণা দেখে ডা. সংযুক্তা সাহার সিরিয়াল পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে। এরপরে সেটি একসময় পেয়েও যায় ইয়াকুব আলী ও মাহবুবা রহমান আঁখি দম্পতি।
গর্ভাবস্থার পঞ্চম মাসে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডা. সংযুক্তা সাহার চেম্বারে
ইয়াকুব আলী বলেন, গর্ভাবস্থার আগে ও শুরু থেকেই ডা. সংযুক্তা সাহাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ফলো করতেন আঁখি। আর তাই শুরু থেকেই সিরিয়াল পাওয়া চেষ্টা করা হচ্ছিল। পরবর্তীতে ডা. সংযুক্তা সাহারই দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করে সেখানে যাই আমরা।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৩ মার্চ দেওয়া প্রেসক্রিপশনে দেখা যায়, মাহবুবা রহমান আঁখি গর্ভাবস্থার ২৮তম সপ্তাহে ডা. সংযুক্তা সাহার কাছে চিকিৎসা পরামর্শ নিতে যায়। এদিন তার ওজন মেপে প্রেসক্রিপশনে লেখা হয় ৬১ কেজি। তার সিস্টোলিক প্রেশার ছিল ৯০ ও ডায়াস্টোলিক প্রেশার ছিল ৬০।
এই প্রেসক্রিপশন পর্যালোচনা করে চিকিৎসাসেবার পরামর্শের পাশাপাশি আরও কিছু বিষয়ে লক্ষ করা যায়। সেখানে তিনটি সিল দেওয়া হয়। যার একটিতে লেখা গাইনি ইমার্জেন্সি, রুম নং ৫০৯, সেন্ট্রাল হসপিটাল লিমিটেড। আরেকটিতে লেখা ডেলিভারি এবং ভর্তি সংক্রান্ত তথ্যের জন্য ০১৭১৩-০০****। সবার উপরে আরেকটি সিলে লেখা আছে Md. Jomir, 01710****।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে মো. জমির ডা. সংযুক্তা সাহার ব্যক্তিগত গাড়ি চালকের নাম।
ইয়াকুব আলী বলেন, ‘আমাদেরকে বলা হয়েছিল যে কোনো জরুরি অবস্থায় যেনো এসব জায়গাতেই যোগাযোগ করি।’
গর্ভাবস্থার শেষ দিকে তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আঁখি
ডা. সংযুক্তা সাহার ফলোআপ চিকিৎসার পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিভিন্ন চিকিৎসা পরামর্শের জন্য যেতেন মাহবুবা রহমান আঁখি।
আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী বলেন, ‘ডা. সংযুক্তা সাহা ম্যাডামের চিকিৎসাতেই আমরা ছিলাম। তিনিই বলেছেন খুব বেশি সমস্যা না হলে ঢাকায় যাওয়ার দরকার নেই। উপজেলাতেই কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে হবে। সেই হিসেবে আমরা তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই চিকিৎসকের কাছে যেতাম। সেখানে ডা. আয়েশা আমাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন।’
৩০ এপ্রিল তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে টিকেট কেটে চিকিৎসকের পরামর্শ নেন মাহবুবা রহমান আঁখি। এদিন তার ওজন মেপে প্রেসক্রিপশনে লেখা হয় ৫৯ কেজি ও সিস্টোলিক প্রেশার ছিল ৯০ এবং ডায়াস্টোলিক প্রেশার ছিল ৬০।
ইয়াকুব আলী বলেন, ‘ওর তেমন কোনো মেজর সমস্যা ছিল না। আর যখনই কোনো কিছু নিয়ে সমস্যাবোধ করত তখন আমরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে পরামর্শ নিতাম।’
৭ জুন তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে টিকেট কেটে আবার চিকিৎসকের পরামর্শ নেন মাহবুবা রহমান আঁখি। এদিন তার ওজন মেপে প্রেসক্রিপশনে লেখা হয় ৬১ কেজি ও সিস্টোলিক প্রেশার ছিল ১০০ এবং ডায়াস্টোলিক প্রেশার ৭০। এদিন চিকিৎসক সম্ভাব্য করণীয় বিষয়ে প্রেসক্রিপশনে পরামর্শ লিখে দেন। বাচ্চার নড়াচড়া খেয়াল রাখার পরামর্শ দেন। এর পাশাপাশি বাচ্চা কম নড়লে বা ব্যথা বাড়লে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন।
৯ জুন দুপুরের দিকে লেবার পেইন শুরু হলে তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই নিয়ে যাওয়া হয় মাহবুবা রহমান আঁখিকে। কিন্তু এই বিষয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি কেউই বিস্তারিত তথ্য দিতে রাজি হয়নি প্রতিবেদককে। তবে তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের টিকেট খুঁজে পাওয়া গেছে মাহবুবা রহমান আঁখিকে প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি করানোর তথ্য।
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, দুপুর ১২ টা ৫০ মিনিটের দিকে তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয় আঁখিকে। এ সময় নানা পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে আঁখির পরিবারের সদস্যদের জানানো হয়, স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসব সম্ভব না প্রোলংড লেবার কেইস হওয়ার কারণে।
চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায়, প্রসবকালীন সময়ে নবজাতক শিশুর পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়সীমা যদি ২৪ ঘণ্টার বেশি হয় তবে তাকে বিলম্বিত প্রসব বা প্রোলংড লেবার বলা হয়ে থাকে।
আঁখির পরিবারের সদস্যদের তার শারীরিক অবস্থার আপডেট জানানোর পাশাপাশি সেখানে উপস্থিত মিডওয়াফ হিসেবে দায়িত্বরতরা তাকে সেবা দিতে থাকে।
সেখানে দায়িত্বরত একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আঁখির শাশুড়ি, ভাই ও তার স্বামীকে সব আপডেট জানানো হয়। কিন্তু এ সময় আঁখি তার স্বামীকে বলে ডা. সংযুক্তা সাহার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। একমাত্র তিনিই নরমাল ডেলিভারি করাতে পারবেন এমনটাই বলছিলেন আঁখি তার স্বামীকে।’
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দুপুর ১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত যতক্ষণই হাসপাতালে ছিলেন তারা আঁখি বারবারই ডা. সংযুক্তা সাহার কাছে যাওয়ার কথা বলছিলেন। পরবর্তীতে রাত ১০টার দিকে হাসপাতালের লেবার রুম থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দিয়ে চলে যায় আঁখি ও তার পরিবারের সদস্যরা।
তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোনো কর্মকর্তাই।
তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. সরফরাজ হোসেন খান বলেন, ‘এ বিষয়টি একটি তদন্তাধীন পর্যায়ে আছে। আর তাই আমি কোনো কিছুই বলতে চাইছি না।’
এ ঘটনার পরে কুমিল্লা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকেও একটি তদন্ত টিম যায় তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তবে কেউ এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
৯ জুন তিতাস উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে ভর্তির বিষয়ে কী বলছেন ইয়াকুব?
মাহবুবা রহমান আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার পরে সেখানে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন না। হাতেগোনা কয়েকজন নার্স ছিলেন। আর যে চিকিৎসক ছিলেন তিনি আসলেই সার্জারি করতে পারবেন কিনা তেমন কিছু বলেননি। সেই সময়েই সেখানে কয়েকজন স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে সিজার করতে বলছিলেন। তাদের পরিচিত জায়গায় সিজার করানোর কথা বলছিলেন। কিন্তু আমরা তো ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলাম। তাই অন্য কোথাও কেনো ডেলিভারি করাব? ডা. সংযুক্তা সাহাই তো বলেছিলেন নরমাল ডেলিভারি করাবেন। আর তাই আমার স্ত্রীর অনুরোধে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি।’
তিনি বলেন, ‘ডা. সংযুক্তা সাহাকে তো আর সরাসরি ফোনে পাওয়া যায় না। কিন্তু তিনি প্রেসক্রিপশনে যোগাযোগের উপায় বলে দিয়েছিলেন। সেই হিসেবে আমরা ওনার ব্যক্তিগত গাড়ির চালক জমিরের কাছে ফোন দেই। জমির আমাদের জানায়, ম্যাডাম ওটিতে আছেন আর তাই তিনি কথা বলতে পারছেন না। আমরা যেন দ্রুত চলে যাই সেন্ট্রাল হাসপাতালে। ম্যাডাম আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে বলেও জানান জমির।’
ইয়াকুব বলেন, ‘আমরা তাও আবার জমিরকে বলি যে এরইমধ্যে তিতাসে রাখা হয়েছে আঁখিকে। রওয়ানা দিয়ে ঢাকা আসতে আসতে একটু রাত হয়ে যেতে পারে। এমন অবস্থায় রাত সাড়ে ১১টা ১২টার দিকে পৌঁছালে ম্যাডামকে কী পাওয়া যাবে কিনা তাও জানতে চাই জমিরের কাছে। তখন জমির আমাদের নিশ্চিত করে সংযুক্তা সাহা ম্যাডামকে পাওয়ার বিষয়ে। এ সময়ে তিনি একটি কনফারেন্সের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে একজন অ্যাসিস্ট্যান্টের কথা বলিয়ে দিয়ে মাহবুবা রহমান আঁখির নামে একটি সিরিয়াল দেয়।’
তিনি বলেন, ‘এরপরেই মূলত আমরা একটা প্রাইভেটকার রিজার্ভ করে সেন্ট্রাল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। গাড়িতে আমরা আঁখিকে বোঝাচ্ছিলাম যে যদি ডা. সংযুক্তা সাহা বেশি রাত হয়ে গেলে না থাকে তবে আদদ্বীন হাসপাতালে চলে যাব। অনেক কষ্টে তাকে এই বিষয়ে রাজি করানো হয় রাস্তায়। কিন্তু এরপরে যা ঘটেছে তা তো সবাই জানে।’
কুমিল্লায় চিকিৎসকরা স্বাভাবিকভাবে ডেলিভারি সম্ভব না বলার পরেও কেনো ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হলো?— এমন প্রশ্নের উত্তরে ইয়াকুব বলেন, ডা. সংযুক্তা সাহা যেভাবে নরমাল ডেলিভারির কথা বলতেন তা তো অন্যরা বলত না। আর তাই অন্যরা সিজারের (সি-সেকশন) কথা বলাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ডা. সংযুক্তা তো আর অন্যদের মতো না। আমার স্ত্রী এমনটাই বিশ্বাস করতেন। তার বিশ্বাস ছিল ডা. সংযুক্তা সাহাই একমাত্র চিকিৎসক বাংলাদেশে যিনি স্বাভাবিক নিয়মে ডেলিভারি করাতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘বাচ্চা ও আঁখিকে তো আর ফিরে পাব না। কিন্তু এখন যেভাবে যা বলা হচ্ছে তা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা তো টাকা খরচ করেই চিকিৎসা করাতে গেছিলাম ডা. সংযুক্তা সাহার কাছে। তার প্রেসক্রিপশনে থাকা জমিরের নম্বরে ফোন দিয়ে ম্যাডাম থাকার বিষয়েও কনফার্ম হয়েছি। এরপরেই আমরা তিতাস থেকে রওয়ানা দেই সেন্ট্রাল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। আর তাই অন্য কারো পরামর্শ না নিয়ে তার কাছেই চিকিৎসা নিতে গেছি। এটি কী আমাদের ভুল?’
ডা. সংযুক্তা সাহাই তো আমাদের নরমাল ডেলিভারির বিষয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন। অন্য চিকিৎসকরা যা পারবে না বা করে না সেটিই তিনি স্বাভাবিকভাবে নরমাল ডেলিভারি করিয়ে সবার উপকার করে বলে জানিয়েছিলেন। ফেসবুক লাইভেও তিনি যা বলতেন আঁখি তাই বিশ্বাস করতেন। আমরাও করেছি বিশ্বাস তার কথায়। তবে কী চিকিৎসকের কথায় ভরসা রাখা যাবে না? তাহলে কী দেশের প্রতিটা মানুষকে চিকিৎসা নেওয়ার আগে চিকিৎসা শাস্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে?- প্রশ্ন রাখেন ইয়াকুব আলী সুমন।
তবে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ডা. সংযুক্তা সাহা ও তার গাড়ির চালকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, ৯ জুন রাত ১২টা ৫০ মিনিটে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে ভর্তি করা হয় কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলা থেকে আসা মাহবুবা রহমান আঁখিকে। পরবর্তীতে ভুল চিকিৎসা ও সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় নবজাতক শিশুকে হারানোর পাশাপাশি মাহবুবা রহমান আঁখি মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েছেন বলে অভিযোগ জানান তার স্বামী। ১০ জুন সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে ল্যাব অ্যাইড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় মাহবুবা রহমান আঁখিকে।
ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় ১৫ জুন ধানমন্ডি থানায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’র একটি মামলা দায়ের করেন ইয়াকুব আলী। মামলায় ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা, ডা. মুনা সাহা, ডা. মিলি, সহকারী জমির, এহসান ও হাসপাতালের ম্যানেজার পারভেজকে আসামি করা হয়। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়। মামলা দায়েরের পর ১৫ জুন ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনা সাহাকে হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরবর্তীতে ১৮ জুন রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে মারা যান মাহবুবা রহমান আঁখি।
এ ঘটনায় একে অপরকে দোষারোপ করে এরইমধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ডা. সংযুক্তা সাহা।