নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লার ওপর দিয়ে নির্মাণ হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ
সড়কপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৪৮ কিলোমিটার। রেলপথে এ দূরত্ব ৩২০ কিলোমিটার। ট্রেনে ঢাকা-চট্টগ্রামে যাতায়াত করতে হয় টঙ্গী-ভৈরব-আখাউড়া ঘুরে। এ দূরত্ব কমাতে ঢাকা থেকে কুমিল্লার লাকসাম পর্যন্ত রেলপথটি সোজা করে (কর্ড লাইন) নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এজন্য ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে কুমিল্লা পর্যন্ত তৈরি করা হবে ৮০ কিলোমিটারের বেশি নতুন রেলপথ। বর্তমানে একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে রেলপথটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নকশা প্রণয়নকাজ চলমান। এ প্রকল্পের মাধ্যমে এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে তিনটি সম্ভাব্য রুট।
‘রেলওয়ে কানেক্টিভিটি ইম্প্রুভমেন্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি’ নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা-লাকসামের মধ্যে কর্ড লাইন নির্মাণের জন্য এ সমীক্ষা করা হচ্ছে। এজন্য জাপান, ফ্রান্স ও মালয়েশিয়ার তিন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের একটি কনসোর্টিয়ামকে নিযুক্ত করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত সপ্তাহে রেল ভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় প্রস্তাবিত কর্ড লাইনের ওপর একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেছে পরামর্শকদের এ কনসোর্টিয়াম। তাতে সম্ভাব্য রুট তিনটির বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে রেলপথে যাতায়াতে সময় লাগে প্রায় ৫ ঘণ্টা। কর্ড লাইন নতুন রেলপথটি নির্মাণ হলে ভ্রমণ সময় দেড় ঘণ্টা কমে আসবে। সব মিলিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দূরত্ব কমবে প্রায় ৯০ কিলোমিটার। অন্যদিকে টঙ্গী-ভৈরব-আখাউড়ার মধ্যকার বিদ্যমান লাইনটিও সচল থাকবে। দুই লাইনে গতিশীল হবে রেলওয়ের যাত্রী ও পণ্য পরিবহন।
২০২৬ সাল নাগাদ ঢাকা-লাকসাম কর্ড লাইন রেলপথের নির্মাণকাজ শুরুর প্রত্যাশা করছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান। তিনি এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমানে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিস্তারিত নকশা তৈরির কাজ চলছে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে এসব কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। এরপর ফান্ডিংয়ের বিষয় আছে। আমরা আশা করছি এডিবির ফান্ডিং পাব। তার পরে ডিপিপি অনুমোদন, ভূমি অধিগ্রহণ, ঠিকাদার-পরামর্শক নিয়োগের মতো কাজগুলো করতে হবে। এসব কাজ করতে আনুমানিক দেড় বছর সময় লাগতে পারে। আমরা আশা করছি ২০২৬ সালের শুরুতে প্রকল্পটির কাজ মাঠ পর্যায়ে শুরু করার।’
নতুন লাইন হলে টঙ্গী-ভৈরব-আখাউড়া-লাকসামের মধ্যকার বিদ্যমান রেলপথটি পণ্য পরিবহনের জন্য বিশেষায়িত করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান লাইনটি পণ্য পরিবহনের জন্য বিশেষায়িত করা যাবে না। কারণ চট্টগ্রাম-সিলেট, চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ রুটের যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনার জন্য বিদ্যমান লাইনটি প্রয়োজন হবে। বিশেষায়িত করা না হলেও বিদ্যমান লাইনটি দিয়ে আরো বেশি পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হবে।’
ঢাকা-লাকসাম কর্ড লাইন রেলপথ নির্মাণের জন্য প্রাথমিকভাবে তিনটি বিকল্প রুট প্রস্তাব করেছে প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। ‘অপশন ১’-এ রাখা হয়েছে ঢাকা-কদমতলী-নারায়ণগঞ্জ সদর-বন্দর-সোনারগাঁ-মেঘনা-তিতাস-মুরাদনগর-দেবীদ্বার-বুড়িচং-কুমিল্লা সদর রুটকে। রুটটির দৈর্ঘ্য ৮২ দশমিক ৫ কিলোমিটার। কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশনের সাড়ে তিন কিলোমিটার উত্তরে নতুন রেলপথটি বিদ্যমান ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ রুটের ২০ দশমিক ৭ কিলোমিটার অংশ তৈরি করতে হবে উড়ালপথে। বড় সেতু নির্মাণ করতে হবে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার। এর বাইরে তৈরি করতে হবে ৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মেঘনা সেতু। শিল্প এলাকার উত্তর দিকে তৈরি করতে হবে এ সেতু। রেলপথের জন্য বাঁধ তৈরি করতে হবে ৫৫ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে ‘অপশন ১’-এর জন্য প্রাথমিকভাবে নির্মাণ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।
ঢাকা-কদমতলী-নারায়ণগঞ্জ সদর-বন্দর-সোনারগাঁ-মেঘনা-দাউদকান্দি-তিতাস-মুরাদনগর-চান্দিনা-বরুড়া-কুমিল্লা সদর দক্ষিণ-লাকসাম রুটকে ধরা হয়েছে ‘অপশন ২’ হিসেবে। এ রুটের দৈর্ঘ্য ৯৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। এর জন্য শিল্প এলাকার উত্তর দিকে ৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মেঘনা সেতু তৈরি করতে হবে। এ রুটে বড় সেতুর প্রয়োজন পড়বে ২ দশমিক ৭ কিলোমিটার। উড়ালপথ বা ভায়াডাক্ট তৈরি করতে হবে ২০ দশমিক ৭ কিলোমিটার। লাকসাম স্টেশনে বিদ্যমান ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের সঙ্গে সংযুক্ত হবে নতুন রেলপথ। ৬৯ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা খরচ হবে এ রুটে নতুন রেলপথ নির্মাণে।
‘অপশন ৩’ হলো ঢাকা-কদমতলী-নারায়ণগঞ্জ সদর-বন্দর-সোনারগাঁ-গজারিয়া-দাউদকান্দি-চান্দিনা-বরুড়া-কুমিল্লা সদর দক্ষিণ-লাকসাম রুট। এ রুটের দৈর্ঘ্য ৯১ কিলোমিটার। রেলপথটির জন্য ১৭ দশমিক ৭ কিলোমিটার উড়ালপথ তৈরি করতে হবে। বড় সেতু নির্মাণ করতে হবে সাড়ে তিন কিলোমিটার। শিল্প এলাকার দক্ষিণে নির্মাণ করা হবে মেঘনা সেতু, যার দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার। লাকসাম স্টেশনে বিদ্যমান ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের সঙ্গে সংযুক্ত হবে নতুন রেলপথ। ‘অপশন ৩’-এ ঢাকা-লাকসাম কর্ড লাইন নির্মাণ করতে খরচ হবে ৬৫ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা।
এর মধ্যে সবচেয়ে কম দূরত্বের ‘অপশন ১’-এ ঢাকা-লাকসাম কর্ড লাইন রেলপথ নির্মাণের সুপারিশ করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী, লাইনটি হবে ব্রড গেজের। ভার বহনক্ষমতা বা এক্সেল লোড হবে ২৫ টন। ডিজাইন স্পিড হবে ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির ওপর গত সপ্তাহে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যে সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেছে তা গ্রহণ করেননি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা। বিশেষ করে সম্ভাব্য বিকল্প রুটগুলোর নির্মাণ ব্যয় এবং নকশাগত বিভিন্ন বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন তারা। এজন্য পরামর্শকদের বিষয়গুলো আরো পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন বিষয় সংশোধনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।