হাজার বছরের ময়নামতির ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা’র সমাপ্তি!
মো.জাকির হোসেনঃ কুমিল্লার ঐতিহাসিক লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের সর্বউত্তরের জনপদ ময়নামতি। দেশের অন্যতম প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শণ রানী ময়নামতি প্রাসাদটির অবস্থান এখানে। এই প্রাসাদটিকে ঘিরে হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের লোকজন বৈশাখকে উপলক্ষ্য করে মেলা অনুষ্ঠান করে আসছিল।
লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের বিচ্ছিন্ন চূড়ায় লোকনাথ পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতি বৈশাখের ৭ তারিখে শুরু হওয়া এই মেলা মাসব্যাপী বড় পরিসরে অয়োজন হতো। জনশ্রুতি আছে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত মানুষের নিত্য যাবতীয় পণ্য এই মেলায় পাওয়া যেত। ফলে মেলাটির পরিচিতি ছিল দেশ ব্যাপী। কবে এটা চালু হয়েছিল তার সঠিক দিন বা সন জানা না গেলেও জনশ্রুতি আছে, দেশের অন্যতম প্রাচীন মেলা এটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের সময় ছাড়া এই মেলাটির কেন্দ্রস্থল ছিল রানী ময়নামতির প্রাসাদ ঘিরে। বিগত ১৪২১ বাংলায় রানী ময়নামতি প্রাসাদ এলাকায় বৈশাখী মেলার আয়োজকরা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কোন অনুমতি ছাড়াই প্রাসাদের মূল প্রবেশ পথ সংলগ্ন স্থানে খনন করায় মামলা করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। এরপরও বিগত ১৪২২ ও ’২৩ বাংলা সনে এখানে স্বল্প পরিসরে মেলার আয়োজন হয়। তবে ১৪২৪ সাল থেকে অজ্ঞাত কারণে মেলাটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন কালী মন্দীর এলাকায় মন্দির কর্তৃপক্ষ মেলাটির আয়োজন করে। জেলা প্রশাসন অনুমতি না দেওয়ায় আসন্ন বৈশাখের ৭ তারিখে মেলাটি অনুষ্ঠানের সম্ভাবনাও এখন আর নেই। আর এভাবে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বৈশাখী মেলাটি বন্ধ হওয়ায় ময়নামতির ইতিহাসে বৈশাখী মেলার যে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল সেটা মুছে গেছে।
জনশ্রুতি আছে, ময়নামতি এলাকায় বৈশাখের প্রথম দিন থেকে টানা ৬ দিনে হরিণধরা, রায়পুর, বাজেবাহেরচর, গনেষপুর, মিরপুর এলাকায় বৈশাখী মেলা হয়। এরপর ৭ বৈশাখ রানী ময়নামতি প্রাসাদের চারিদিকসহ আশপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে জেলার অন্যতম বৃহৎ বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হতো। এবারেও এক বৈশাখ থেকে ৬ বৈশাখ পর্যন্ত মেলা হবে, তবে বৃহৎ আকারের ময়নামতি মেলা আর অনুষ্ঠিত হবেনা।
কুমিল্লার ঐতিহাসিক লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ে আবিস্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অন্যতম রানী ময়নামতি প্রাসাদ। কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পাশে বিচ্ছিন্ন একটি পাহাড়ের উপর এই প্রাসাদের অবস্থান। এর পশ্চিম-উত্তর কোনে রয়েছে একটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কালীমন্দির। পাহাড়ের মাঝে থাকা প্রাসাদের চারিদিকে বিশাল জায়গাজুড়ে সমতল ভূমি।
স্থানীয় বয়স্ক একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, ,বছরের পর বছর ধরে সনাতন ধর্মের লোকেরা লোকনাথ পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতি বাংলা বছরের শুরুতে বৈশাখের ৭ তারিখ থেকে মাস ব্যাপী রানী ময়নামতি প্রাসাদকে কেন্দ্র করে এর চারিদিকসহ কালীমন্দির, ময়নামতি স্কুল এন্ড কলেজ ও ময়নামতি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের আশপাশ, স্থানীয় সাহেবের বাজার, ময়নামতি গরুর বাজার এলাকাজুড়ে মেলা অনুষ্ঠিত হতো।
ময়নামতি এলাকার বর্তমানে ঢাকার জিগাতলার বাসিন্দা দিলরুবা ইকবাল (৮৬) জানান, ছোট বেলায় মেলার সময় দেখা যেত রানী প্রাসাদের চারিদিকে অসংখ্য দোকানী বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী নিয়ে জড়ো হতো। এছাড়া প্রাসাদের মূল প্রবেশ পথের দু’দিক হতে সাহেবের বাজার পর্যন্তও শত শত দোকানী নানা পণ্য নিয়ে বসতো। তাদের কেউ বাঁশী ,শিশুদের বিভিন্ন ধরনের খেলনা, বেলুন, মাটির তৈরী পুতুল ঘোড়া, হাতি, পাখি, মিষ্টি, মুড়ি, কদমা, জিলাপী, বাদাম, হাতপাখা, চুরি, ফিতা, দা, কাচি, তুলা, কোদাল, কুঠার, নাঙ্গল,হাড়ি-পাতিল, বিভিন্ন প্রকারের আসবাবপত্রসহ অন্যান্য নানা জিনিসপত্র বিক্রির জন্য নিয়ে আসতো।
স্থানীয় সমেষপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ময়নাল ফকির জানান, ১৯৮৮ সালে রানী ময়নামতি প্রাসাদের ব্যাপক খনন হয়। এর আগে এবং বর্তমানেও রানী ময়নামতি প্রাসাদ এলাকাটি প্রায় অরক্ষিত। আর শুধুমাত্র বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করেই এখানে মানুষের সমাগম হতো। এরপর ১৪২১ বাংলা সালে প্রত্নতত্ত বিভাগের অনুমতি ছাড়া মেলার আয়োজকরা ময়নামতি প্রাসাদ এলাকায় খনন কাজ করলে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ মামলা করে। তিনি আরো জানান, প্রতিবছর ময়নামতি মেলাকে কেন্দ্র করে বুড়িচং, কুমিল্লা সদর,সদর দক্ষিণ, চান্দিনা, দেবীদ্বার এলাকার গ্রামগুলোতে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়। এসময় দেশের বিভিন্নস্থানে থাকা উল্লেখিত এলাকার লোকজন মেলা উপলক্ষে নিজ এলাকায় ছুটে আসে। একইভাবে ময়নামতি এলাকায় বসবাসকরা বিভিন্ন স্থানের লোকজনের স্বজনদের কেউ কেউ মেলা উপলক্ষে বেড়াতে আসে।
স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, ময়নামতি মেলায় দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত মানুষের ব্যবহৃত সকল জিনিসপত্র বেচাকেনা হয়। ময়নামতি সিন্ধুরিয়াপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ পাকিস্তান জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার হুমায়ুন কবীর (৮৪) জানান, রানীর বাংলো হিসেবে পরিচিত ময়নামতি প্রাসাদকে ঘিরেই ময়নামতি মেলা হতো। দেশের বিভিন্নস্থান থেকে অসংখ্য বিক্রেতা নানা ধরণের পসরা নিয়ে আসতো এই মেলায়। যদিও এটা মাসব্যাপী ছিল,তবে আসবাবপত্র বিক্রি হতো দেড়/দু মাস ধরে। তিনি আরো জানান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মেলাটি রানীর বাংলোর পাশে ময়নামতি গরুর বাজার এলাকায় অনুষ্ঠিত হতো। তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমলে দেখেছি মেলার সময় বাসে করে কুমিল্লা, চান্দিনা, মুরাদনগরসহ বিভিন্নস্থান থেকে অনেক মানুষ আসতো মেলা দেখতে। তিনি আরো বলেন, ময়নামতি বৈশাখী মেলা এই এলাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক। সাম্প্রতিক সময়ে মেলাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, এতে কুমিল্লার ময়নামতি বৈশাখী মেলার সাথে জড়িত অনেক কৃষ্টি,সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে।
শত শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী ময়নামতি বৈশাখী মেলা বন্ধের বিষয়ে রানী ময়নামতি প্রাসাদ সংলগ্ন সনাতন সম্প্রদায়ের কালী মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারন সম্পাদক এড কিংকর দেবনাথ বলেন,এই মেলা কুমিল্লার কৃষ্টি, সংস্কৃতির সাথে জড়িত। তবে আমরা মন্দির কর্তৃপক্ষ নিজস্ব আয়োজনে মেলাটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবো। তিনি বলেন, মেলা আয়োজন করে সরকার প্রতিবছর একটা রাজস্ব আয় করতো। বর্তমানে সেটা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় রাজস্ব আয় বন্ধ হয়ে গেলো। কিংকর দেবনাথ আরো বলেন,ময়নামতি বৈশাখী মেলা উপলক্ষে আশপাশের এলাকা না পাশ্ববর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বসবাস করা অনেক সনাতন ধর্মের লোকজনও আসতো।
এবারে মেলার আয়োজনের অনুমতি চাওয়া বুড়িচং উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সহকারী কমান্ডার ফজর আলী বলেন,ময়নামতি বৈশাখী মেলা আমাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। মেলার মূল আয়োজনটি হতো রানী ময়নামতি প্রাসাদ এলাকায়। রানী ময়নামতি প্রাসাদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীন। বর্তমানে সেখানে সীমানা প্রাচীর নির্মানসহ খননে উন্মোচিত বিভিন্ন স্থাপনার সংস্কার কাজ হচ্ছে। তাদের আপত্তির কারণে এখন আর মেলা অনুষ্ঠানের অনুমতি দিচ্ছেনা প্রশাসন। ফলে শত শত বছরের পুরনো মেলাটি অনেকটা সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে হারিয়ে গেল।
বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলেন, জেলা প্রশাসনের অনুমতি না থাকায় মেলা আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়নি।