কুমিল্লা-৭(চান্দিনা) আসনে মুখোমুখি তিন হেভিওয়েট প্রার্থী
ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) সংসদীয় আসন মানেই হয় আলী আশরাফ, না হয় রেদোয়ান আহমেদ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংসদ আলী আশরাফ এর আগেও তিনবার এখানে সাংসদ ছিলেন। আর বিএনপি ও জাতীয় পার্টির টিকিটে চারবার সাংসদ হন রেদোয়ান। অবশ্য রেদোয়ান এখন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব। এই দুই রাজনীতিক ঘুরেফিরেই চান্দিনার মানুষের হয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন।
তবে এবার এ আসনে নতুন মুখ হিসেবে মাঠে নেমেছেন ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, এখন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। সাংসদ আশরাফের অভিযোগ, প্রাণ গোপাল এলাকায় দলের মধ্যে ‘বিশৃঙ্খলা’ তৈরি করছেন। আর প্রাণ গোপাল বলছেন, তিনি চান্দিনার তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ‘মনের দুঃখ’ ঘোচাতে চান।
বর্তমানে এই দুই নেতার নেতৃত্বে বিভক্ত এখানকার আওয়ামী লীগ। গত এক বছরে দুই পক্ষের মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ২০টি হামলা-মামলার ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির শক্তিশালী মনোনয়নপ্রত্যাশী না থাকায় সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন এলডিপির রেদোয়ান।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলা। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা আর কৃষি ও শিল্পকারখানার কারণে এ উপজেলার গুরুত্বই আলাদা। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আলী আশরাফ নৌকার প্রার্থী রমিজ উদ্দিন আহমেদকে ৫ হাজার ৭৯০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। এরপর আলী আশরাফ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। পরে’ ৭৯-এর নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থী রেদোয়ান আহমেদের কাছে ৬ হাজার ৩৭৫ ভোটে হেরে যান।’ ৮৬-এর নির্বাচনে রেদোয়ান জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করে আলী আশরাফকে পরাজিত করেন।’ ৯১ সালে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ে মাত্র ৫৪৮ ভোটে আলী আশরাফকে পরাজিত করেন।’ ৯৬-এর নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন রেদোয়ান। তখন ৩৬৬ ভোটে হেরে যান আলী আশরাফের কাছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে আলী আশরাফ প্রায় ৫০ হাজার ভোটে হেরে যান রেদোয়ানের কাছে। ২০০৮ সালে আলী আশরাফ ৫ হাজার ৫৭০ ভোটের ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থী খোরশেদ আলমকে পরাজিত করেন। আর এলডিপির প্রার্থী হয়ে তৃতীয় হন রেদোয়ান। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন আলী আশরাফ।
আওয়ামী লীগ
চান্দিনা উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির নেতারা প্রকাশ্যেই সাংসদ আলী আশরাফের পক্ষে। তবে কমিটির বাইরে দলের একটি অংশ প্রাণ গোপালের পক্ষে। এ অংশের নেতারা প্রাণ গোপাল দত্তকে নিয়ে চান্দিনায় গণসংযোগ করছেন। মাঠে সক্রিয় প্রবীণ নেতা আলী আশরাফও।
প্রাণ গোপাল দত্তের অনুসারী তৃণমূল আওয়ামী লীগের অন্তত পাঁচজন নেতার অভিযোগ, বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সাংসদ আশরাফের লোকজন চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম করেছেন। এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাও দিয়েছেন। এ জন্য আলী আশরাফের প্রতি ক্ষুব্ধ একাংশের নেতা-কর্মীরা।
উপজেলার মাইজখার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সেলিম প্রধান বলেন, গত ইউপি নির্বাচনে টাকায় মনোনয়ন বিক্রি হওয়ায় তিনি দলের মনোনয়ন পাননি। স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন। এখন তিনি প্রাণ গোপালের সঙ্গে আছেন।
উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রাণ গোপাল দত্তকে দিয়ে চান্দিনার উন্নয়ন সম্ভব। এ জন্য তিনি তাঁর সঙ্গে আছেন।
প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, তিনি মনোনয়ন চাইবেন। দল মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করবেন। না দিলে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন। তিনি চান্দিনার উন্নয়নের জন্য কাজ করতে চান। এক প্রশ্নের জবাবে প্রাণ গোপাল বলেন, ‘চান্দিনার আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের দুঃখ ঘোচাতে চাই।’
সাংসদ আলী আশরাফ বলেন, যাঁরা নৌকার বিরোধিতা করছেন, তাঁদের এবং ফ্রিডম পার্টির নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রাণ গোপাল দত্ত এলাকায় দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন। তিনি দাবি করেন, তিনি বা তাঁর লোকজন টাকা দিয়ে কাউকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেননি। এলাকায় কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলাও করা হয়নি। একজন চেয়ারম্যান ছাড়া চান্দিনা আওয়ামী লীগের সব কমিটির নেতা-কর্মীরা তাঁর পক্ষে আছেন বলে তিনি মনে করেন।
এলডিপি
এ আসন থেকে বিএনপিসহ একাধিক দলের মনোনয়ন নিয়ে চারবার সংসদ সদস্য ছিলেন ড. রেদোয়ান আহমেদ। ২০ দলীয় জোটে বিএনপিসহ পাঁচটি দলের অস্তিত্ব রয়েছে চান্দিনায়। রেদোয়ান আহমেদ এলডিপির মহাসচিব হওয়ায় মহাজোটের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও রয়েছেন। জোটের প্রার্থী মনোনয়নে এলডিপিকে বিএনপি প্রাধান্য দেবে বলে জানান রেদোয়ান অনুসারীরা। ’৭৯ সালে বিএনপি থেকে, ’৮৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে, ’৯১ সালে স্বতন্ত্র ও ২০০১ সালে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন রেদোয়ান আহমেদ। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হন তিনি। ২০০৬ সালে কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের সঙ্গে এলডিপি গঠন করেন ও মহাসচিবের দায়িত্ব পান।
উপজেলা বিএনপি ও এলডিপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি খোরশেদ আলম কুমিল্লা-৭ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর কারণে ঘুরেফিরে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে রেদোয়ানের নাম চলে আসে। বিএনপির একটি অংশ চায়, রেদোয়ান দলে ফিরে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করুন। আর এলডিপির নেতা-কর্মীরা মনে করেন, ২০-দলীয় জোটে থাকার কারণে তিনি ধানের শীষ প্রতীকই পাবেন।
চান্দিনা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মফিজউদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘রেদোয়ানকে আমরা বিএনপিতে নেব না। তাঁর কারণে কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি ও চান্দিনা উপজেলা বিএনপির সভাপতি খোরশেদ আলম নয়টি মামলা নিয়ে মারা যান। আমার বিরুদ্ধেও সাতটি মামলা রয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে তিনি অসংখ্য মামলা করিয়েছেন। কেন্দ্রকে আমরা বিষয়টি বোঝাব।’
রেদোয়ান আহমেদ বলেন, ‘আপাতত বিএনপিতে ফিরছি না। জোটের প্রার্থী হয়েই নির্বাচন করব।’
বিএনপি
দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতি করে প্রথমে ইউপি চেয়ারম্যান, পরে উপজেলা চেয়ারম্যান হন খোরশেদ আলম। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আলী আশরাফের চেয়ে ৫ হাজার ৫০৭ ভোট কম পেয়ে পরাজিত হন তিনি। ২০০৬ সালে এলডিপি গঠন করে রেদোয়ান আহমেদ বিএনপি ছাড়লে উপজেলা বিএনপির সভাপতি হন খোরশেদ আলম। এরপর এ দুই নেতার মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। দুপক্ষের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনাও ঘটে। সম্প্রতি খোরশেদ আলমের মৃত্যু হয়।
দলের একটি অংশ চাচ্ছে, প্রয়াত নেতা খোরশেদ আলমের একমাত্র ছেলে আতিকুল আলম শাওনকে দলের নেতৃত্বে আনতে। সেখানেও বেঁকে বসে আছেন দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা।
জাতীয় পার্টি
এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি পৃথকভাবে নির্বাচন করলে মনোনয়ন চাইবেন কুমিল্লা উত্তর জেলা সভাপতি লুৎফর রেজা খোকন। গত নির্বাচনে মহাজোটের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি হওয়ায় তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল করেও পরে প্রত্যাহার করেন। এবার জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে সিনিয়র নেতা হিসেবে তিনি চান্দিনা থেকে মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা যায়।
জাপার লুৎফর রেজা খোকন বলেন, গতবার মহাজোটের স্বার্থে ছাড় দেওয়ায় এবার আমি মনোনয়নের দাবিদার। মহাজোট কিংবা দলীয় বিবেচনায় হোক, আমি মনোনয়ন পাওয়ার দাবিদার। তিনি বলেন, মানুষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তারা এখন পরিবর্তন চায়।