কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী ভৈরব সিংয়ের জমিদার বাড়ি
কি সুন্দর প্রশস্ত রাস্তা। সদ্য কার্পেটিং করা হয়েছে। মটরবাইকটি চলছে। উদ্দেশ্য চান্দিনার মহিচাইল। চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া। সেখান থেকে মহিচাইলের দূরত্ব প্রায় ৭ কিঃমিঃ। শান্ত সুনিবিড় রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। মহিচাইলে আছে জমিদার শ্রীযুক্ত বাবু ভৈরব চন্দ্র সিংয়ের বাড়ি।
সাজ্জাদ হোসেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ব্যাংকার সাজ্জাদ হোসেন। তিনি কালিপদ দাদার বন্ধু। বাইক থামিয়ে সাজ্জাদ হোসেনের আতিথ্য গ্রহণ করলাম। ডাবের পানিটা দারুণ স্বাদের ছিলো । নারকেলের অনেকগুলো টুকরো মুখে পুরেছি। সূর্যের আলো থাকতেই পৌঁছাতে হবে। নয়তো সবকিছু ভালো করে দেখা হবে না। ছবিও ভালো আসবে না। সাজ্জাদ ভাইকে সাথে নিয়ে আমরা রওনা দিলাম জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্য।
কি সুন্দর নকশা করা বাড়ি। তবে বিভিন্ন সময়ে একটু একটু করে ভেঙ্গেছে। তাই তিনতলা জমিদার বাড়িটি ভেঙ্গে এখন দু’তলায় পরিনত হয়েছে। অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে বাড়িটি। বাড়ির সামনে বাইক রেখে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে বড় বড় কক্ষ। ছাদে জমে আছে বৃষ্টির পানি। সংরক্ষনের অভাবে ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ছে কক্ষের ভেতরে। ভেতরে প্রবেশ করে দেখি ছোট একটি দরজা। ভেতরে উকি দিয়ে দেখি মাটির নীচে কক্ষের মত। যারা ঠিক সময়ে খাজনা আদায় করতে পারতো না তাদেরকে এই কক্ষে আটকে রাখা হতো। ইংরেজী ইউ আকৃতির বাড়িটি। তবে একটি বাড়ির ছাদ থেকে আরেকটি ছাদে যেতে পুলের মত পথ তৈরী করা হয়েছে। কক্ষগুলোতে জমিদারী আমলের চিহ্ন রয়েছে।
বড় মটকি, আটা তৈরী করার যাতা, খাট- চেয়ার, পাথরের উপর রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য, বেশ কিছু মূল্যবান পাথরসহ আরো কিছু তৈজসপত্র।
মূল জমিদার বাড়ির দু’তলায় রয়েছে একটি জলসা ঘর। সেখানে নাচ-গান হতো। দেয়ালগুলো এখনো সেই স্মৃতি বহণ করে চলছে। প্রতিটি দেয়ালে ছোট ছোট খোপ আছে।। ধারণা করা হচ্ছে এসবে শরাব রাখা হতো। জলসা ঘরের নকশা বেশী আকর্ষনীয়। আমরা দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। জলসা ঘরে অবচেতন মনেই যেন নুপুরের আওয়াজ পেলাম। কোথাও থেকে যেন বীনার সুর ভেসে এলো কানে। দেয়ালে কারুকাজ স্পষ্ট। এখন সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়বে। তিন তলায় একটি সিংহের মূর্তি ছিলো। তিনতলা ক্ষয়ে গেছে। তাই এখন আর সিংহের মূর্তিটিও নেই।
বিশাল এলাকাজুড়ে জমিদার ভৈরব সিংহের জমিদারী তালুক ছিলো। যার মধ্যে সাচার, চান্দিনা, দেবিদ্বার ও কুমিল্লা শহরের কিছু অংশ অর্ন্তভুক্ত ছিলো। যার মধ্যে ছোট বড় মিলিয়ে ৬৪ টি পুকুর ছিলো। এছাড়াও জমিদার বাড়ির অদূরে একটি বড় দিঘী রয়েছে। ওই দীঘি কাটার সময় শ্রমিকরা পাশে একটি ছোট গর্তে কোদাল পরিস্কার করতো। অনেক শ্রমিক মিলে কোদাল পরিস্কার করতে করতে ছোট গর্তটি একটি বড়সর পুকুরে পরিনত হয়েছে। পুকুরটি এখন কোদাল ধোয়া পুকুর নামে পরিচিত। আমরা পুকুরটি দেখতে বেশ নান্দনিক লাগছে।
মহিচাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের জায়গাটি জমিদার ভৈরব সিংহের দেয়া। বিদ্যালয়ের সামনে কত বড় মাঠ। মাধাইয়া থেকে মহিচাইল পর্যন্ত সড়কটি প্রায় ৭ কিঃমি দীর্ঘ। এই সড়কটিও জমিদার ভৈরব সিংহের তৈরী।
বাড়ির পাশের পুকুর পাড়ে রয়েছে জমিদার ভৈরব চন্দ্র সিংহের সমাধিস্থল । লেখা আছে স্বগীর্য় ভৈরব চন্দ্র সিংহ। জন্ম ১২৫৯ বঙ্গাব্দ, মৃত্যু ১৩৩৬।
জমিদার বাড়িতে বেশ কয়েকটি পরিবার বাস করেন। তাদের মধ্যে একটি পরিবার রয়েছে। তারা জমিদারদের পঞ্চম প্রজন্ম বলে দাবী করেন। এ বাড়ির ছেলে সুজন চন্দ্র দে। তিনি জানান, জমিদার ভৈরব চন্দ্র সিংহ সর্ম্পকে তার বড় বাবা। তিনি আমাদেরকে জমিদার বাড়ির বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে দেখান। কোন ঘরে কি আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সুজন জানান, তার মা এ বাড়ির অনেক ইতিহাস জানেন। সুজনের মায়ের নাম লক্ষ্মী রানী দে। জমিদার বাড়ির বউ। কথা হয় উনার সাথে। লক্ষ্মী রানী দে জানান, ১৯৫২ সালে তার জন্ম। তাই এ বাড়ির কিছু ইতিহাস তিনি জানেন এবং কিছু দেখেছেন। জমিদার ভৈরব সিংহের দু’ছেলে। হরধর চন্দ্র সিংহ ও কামিনি চন্দ্র সিংহ। জমিদার বাড়ির প্রবীন মানুষ ক্ষিতিশ চন্দ্র সিংহ। তিনি ২০১৬ সালে মারা যান। ধারণা করা হচ্ছে তিনি জমিদার ভৈরব সিংহের নাতী ছিলেন।
জমিদার ভৈরব চন্দ্র সিংহ বেশ প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন ছিলো জমিদার বাড়ির মানুষজনের। দূরবর্তী যাতায়াতের জন্য জমিদার বাড়ির পুরুষরা হাতি ও ঘোড়া ব্যবহার করতেন। নারীদের জন্য পালকি ছিলো। জমিদারী প্রথার বিলুপ্তির অনেক বছর পর্যন্ত সেই পালকিটি ছিলো। লক্ষী রানী দে সেই পালকিটি দেখেছেন। পরে সংরক্ষনের অভাবে পালকিটি নষ্ট হয়ে যায়। দূর্গাপূজায় এই বাড়িতে বড় মহিষ বলি দেয়া হতো। তখন বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু মানুষের জমায়েত হতো। বাড়িটিতে দীর্ঘ সময় ধরে উৎসব হতো। সময়ের কালক্রমে জমিদারী প্রথার বিলুপ্তি হয়। ভেঙ্গে পড়ছে জমিদারী বাড়িটি। নেই সেই উৎসব।
সন্ধ্যা হয়ে আসছিলো। আমরা ফিরে আসছি। পেছনে ফেলে আসছি ইতিহাস ঐতিহ্যর সেই স্মৃতিচিহ্ন। জমিদার বাড়ি, ঘোড়া, হাতী, আস্তাবল, জলসা ঘর। স্থানীয়দের দাবী, জমিদার ভৈরব চন্দ্র সিংহের বাড়িটি যেন সংরক্ষন করা হয় ইতিহাস রক্ষার স্বার্থে।