কুমিল্লায় হত্যা মামলায় জেল খাটছেন নিরপরাধ সাজ্জাত!
কুমিল্লার বুড়িচংয়ের বাজেবাহেরচরের মমতাজ মিয়ার ছেলে মো. সাজ্জাত। পেশায় টাইলস মিস্ত্রি।
সাজ্জাতের নামে কোনো মামলা ছিল না। ছিল না কোনো অপকর্মের অভিযোগও। কিন্তু এই সাজ্জাতই একটি হত্যা মামলায় জেল খাটছেন।
প্রায় তিন বছর পলাতক থাকার পর দেড় মাস পূর্বে আদালতে হাজিরা দিতে গেলে তার জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় আদালত।
মামলায় পালিয়ে বেড়ানোর কারণে উপার্যন করতে না পারায় দরিদ্র পরিবারে নেমে আসে নির্মমতার খড়গ। শুধু সাজ্জাত নয়, বিস্ফোরক মামলায় বাজেবাহেরচরের স্কুল-কলেজগামী ও কর্মজীবী কিছু ছেলের পরিবারেও নেমে আসে অন্ধকার।
বিষয়টি নজরে এলে মামলার পেছনের ঘটনা জানতে বাংলানিউজ অনুসন্ধানে নামে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৪ মার্চ বাজেবাহেরচরের মৃত জাফর আলীর ঘরের বারান্দায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় ২৫ মার্চ উপ-পরিদর্শক শাহাদাত হোসেন বাদি হয়ে বুড়িচং থানায় বিস্ফোরক আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে এসআই শাহাদাত হোসেন উল্লেখ করেন, ওইদিন ভোর ৫টার দিকে ফয়সাল নামে এক ব্যক্তির ফোন পান তিনি। সাড়ে ৫টার সময় ওই এলাকায় হাজির হয়ে সাক্ষীদের উপস্থিতিতে আলামত জব্দ করেন।
এজাহারে তিনি আরও উল্লেখ করেন, বাড়ির লোকজনসহ আশপাশের মানুষ জানায় রাত ৩টা ৪০মিনিটের সময় বিস্ফোরণের শব্দে তাদের ঘুম ভেঙে যায়। কে বা কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন, তারা তা জানেন না।
এদিকে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে অভিযোগে বাজেবাহেরচরের কবির হোসেনের ছেলে পাভেল প্রকাশ সোহেলকে ওই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৯ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত-২ পাভেলকে প্রেরণের সময় বুড়িচং থানাধীন দেবপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আবু ইউসুফ ফসিউদ্দিন দরখাস্তে উল্লেখ করেন, আসামি পাভেলকে ৮ ফেব্রুয়ারি নিম্নবর্ণিত মামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়। তাকে গ্রেফতারের পর সে জানায়, ঘটনার তিনদিন পূর্বে গোমতী নদীর আইল দিয়ে যাওয়ার সময় বিকেল বেলা তাকে ডাক দেয় হালিম। সে ডাকাত হালিমের সঙ্গে গিয়ে দেখে, রাসেল,রুবেল,সাজু, রাজু, শাকিল, আশিক ও সাজ্জাদ বসা আছে। তারা ওই স্থানে বসে ডাকাতির পরিকল্পনা করে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৩ মার্চ রাত ২টার সময় পাভেল প্রকাশ সোহেলসহ ৭-৮ জন মিলে সোহেলের (প্রকৃতপক্ষে মৃত জাফর আলীর) বাড়িতে যায়। ওই বাড়িতে গিয়ে দেখে বাড়ির লোকজন সামনের রুমে বসে টেলিভিশন দেখছে। এসময় ডাকাতি করতে না পেরে হালিম তার হাতে থাকা একটি পাইপ ঘরের ভিতর ঢিল মারে। যার কারণে বিকট শব্দ হয়। এসময় আসামিরা দৌড়ে পালিয়ে যায়।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২৪ মার্চ রাত ৩ টা ৪০মিনিটের সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আসামি প্রেরণের সময় তা উল্লেখ করা হয় ২৩ মার্চ রাত ২টা। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, তখন সবাই ঘুমিয়ে ছিল। আসামি প্রেরণের সময় উল্লেখ করা হয়, সবাই সামনের কক্ষে টিভি দেখছিল। দুটি বর্ণনাই পুলিশের, যা একটির সঙ্গে আরেকটি সাংঘর্ষিক। এছাড়া এজাহারে শাকিলের নাম উল্লেখ থাকলেও ঘটনার সময় সে বিদেশ ছিল। পরবর্তীতে এজাহার থেকে তার বাদ দেওয়া হয়।
যে বাড়িতে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে, ওই বাড়ির শফিকুল ইসলামের স্ত্রী লিপি আক্তার বলেন, ঘটনার দিন আমরা সবাই ঘুমিয়ে ছিলাম। কারা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, আমরা জানি না।
এ নিয়ে পাভেল প্রকাশ সোহেলের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মারধর করে দেবপুর ফাঁড়ি পুলিশ। একপর্যায়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। আমি বোমা হামলার ঘটনার কিছুই জানি না।
ওই গ্রামের রফিক, সুমন, ডালিম, শামীম, শাজাহান, আবুল কালাম, আবদুল কুদ্দুস, জহির মিয়া, কাউসার, জাহাঙ্গীরসহ আরও বেশ কয়েকজন ব্যক্তি জানান, পাড়ার রাজনীতির কারণে বোমা মেরে পরিকল্পিতভাবে এদের ফাঁসানো হয়েছে। ডাকাত হালিম ছাড়া এদের কারও বিরুদ্ধে মামলা ছিল না। পুলিশ চার্জশিট দাখিলের পূর্বে এলাকায় কোনো প্রকার অনুসন্ধান করেনি।
এ বিষয়ে মামলার চার্জশিট দাখিলকারী কর্মকর্তা এসআই শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটা অনেক আগের ঘটনা। বিস্তারিত মনে নেই। তবে মনে হয়, চার্জশিট জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দাখিল করেছে!
খুনের মামলায় যেভাবে ফেঁসে যান সাজ্জাত:
বোমা হামলার ঘটনার পর ওই বছরের ১৯ এপ্রিল একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় জেলা ডিবি পুলিশের এসআই সহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে পুলিশ জানায়, কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের বুড়িচংয়ের কংশনগর এলাকার ইসলাম ব্রিকফিল্ডের সামনে দুই ডাকাতদলের সংঘর্ষে আবদুল হালিম নামে এক ডাকাত নিহত হয়। ডাকাত আবদুল হালিম বুড়িচংয়ের বাজেবাহেরচর গ্রামের মফিজুল ইসলাম বাবুর ছেলে। মামলার প্রাথমিক এজাহারে ডাকাত হালিমসহ ১১জনকে আসামি করা হয়। চার্জশিটে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা হয়। এদের একজন মৃত ডাকাত হালিম, তিনজন ঘটনাস্থলে গ্রেফতার হয়। ১১নম্বর আসামি সাজ্জাদ পলাতক ছিল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ডাকাত হালিমের সঙ্গে কুমিল্লার দাউদকান্দির সুন্দলপুরের ইদ্রিস আলীর ছেলে এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। ওই সাজ্জাদ হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি। বর্তমানে সে কারাভোগ করছে। সাজ্জাদ কুমিল্লা নগরীর চর্থা, বুড়িচংয়ের দেবপুর ও বাজেবাহেরচরে বিভিন্ন সময় ভাড়া বাসায় ছিল। সে কারণে এলাকার মানুষ তাকে চিনত। হালিম ও সাজ্জাদ বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল বুড়িচংয়ের মানুষ। কিন্তু মামলার চূড়ান্ত চার্জশিট দেওয়ার সময় সন্ত্রাসী সাজ্জাদের নাম বাদ দিয়ে বাজেবাহেরচরের সাজ্জাতের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
নিহত আবদুল হালিমের ভাই ডালিম জানান, হালিম ১৪টি মামলার আসামি ছিল। শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু ফেঁসে যাওয়া সাজ্জাতের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। হালিম হত্যা মামলায় সাজ্জাতের নাম আসায় আমরা অবাক হই। চার্জশিট দাখিলের সময় পুলিশের আরও আন্তরিক হওয়া দরকার ছিল।
সাজ্জাতের ভাই সুমন বলেন, আমার ভাই বিনা কারণে একাধিক মামলায় ফেঁসে গেল। গত দেড় মাস পূর্বে আদালতে হাজিরা দিতে গেলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। চার বছর সে কোনো আয়-উপার্জন করতে পারেনি। আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। চার বছর ধরে আমার মায়ের কান্না থামছে না। মায়ের পেটের ভাইয়ের এমন পরিণতিতে কিছুই করতে পারছি না।
এ বিষয়ে জানতে মামলার বাদি কুমিল্লা ডিবি পুলিশের তৎকালীন এসআই সহিদুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
সূত্রঃ বাংলানিউজ