কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পদ পেতে কোটি টাকার বাণিজ্য!
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠন নিয়ে কোটি টাকার পদবাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কয়েক লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলেও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এতে পদবাণিজ্যের আশঙ্কায় হতাশ হয়ে পড়েছেন ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করে আসা ‘ক্লিন ইমেজ’ধারী পদপ্রত্যাশীরা।
এই পদবাণিজ্যের নেপথ্য সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে জানা গেছে, প্রায় ২০০ একরের ওপর নির্মিত হচ্ছে কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস। ১ হাজার ৬৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার এই ক্যাম্পাসের ভৌত অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ শেষ হলেই আসবাবপত্র ও ল্যাব উপকরণসহ নতুন বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে। এ ছাড়া, ক্যাম্পাসের পরিধি বাড়ার পর সেখানে হাজারখানেক শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হবে। এ মহাযজ্ঞে নিয়োগবাণিজ্য ও টেন্ডারবাজি করে বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এসব কারণে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও স্থানীয় রাজনীতিকদের কাছে বর্তমানে আলোচিত ইস্যু কুবি শাখার কমিটি। ছাত্রলীগের পদ পেয়ে সেখান থেকে বিপুল অর্থ আয়ের লোভে স্থানীয় রাজনীতিকদের কাছে নিজেদের জন্য বিনিয়োগ করতে ধরনা দিচ্ছেন পদপ্রত্যাশীরা।
কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে পদপ্রত্যাশীরা দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান কমিটির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ। তারা নিজেরা নতুন কমিটিতে আসার সুযোগ না থাকায় নিজেদের অনুসারীদের আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
ছাত্রলীগের আরেকটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ২০১৫ সালে গঠিত কুবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহী ও বর্তমান কমিটির যুগ্ম সম্পাদক স্বজন বরণ বিশ^াস। ২০১৭ সালে ওই কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পর রেজা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সহ-সম্পাদক পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা দুজনই নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আসতে চাচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা বা কর্মী হতে ২০০৬ সালে শেখ হাসিনা বয়সসীমা ২৯ নির্ধারণ করেন। সে অনুযায়ী রেজা নিজেই বয়সোত্তীর্ণ। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ অনুযায়ী বর্তমানে তার বয়স ৩১। তবে নতুন কমিটিতে পদ পাওয়ার আশায় সম্প্রতি ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের স্নাতকোত্তর সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি হয়েছেন।
বর্তমান সভাপতি ইলিয়াস অভিযোগ করেন, রেজা কুবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদকের মতো শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করে এসে টাকার বিনিময়ে আবারও সভাপতি প্রার্থী হয়েছে। ইতিমধ্যে শীর্ষস্থানীয় এক নেতার স্ত্রীর বোনকে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছে। ওই টাকা কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়েরই সাবেক এক নেতার মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে।
ইলিয়াস আরও বলেন, রেজা-ই-এলাহীর পক্ষ থেকে শীর্ষ নেতাদের ইতিমধ্যে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তার গ্রুপ থেকে দেওয়া হলে সে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে রাজি আছে বলে দাবি করেছে।
এসব টাকা কার মাধ্যমে লেনদেন করা হয়েছে ইলিয়াস তার নাম বলতে রাজি না হলেও কুবি শাখার জ্যেষ্ঠ নেতারা জানান, আল নাহিয়ান খান জয়ের ঘনিষ্ঠ এক সহ-সভাপতির মাধ্যমেই এ লেনদেন হয়েছে।
তবে টাকা লেনদেনের বিষয় অস্বীকার করে রেজা-ই-এলাহী বলেন, কোথাও একটি পয়সাও আমার দিতে হয়নি। এগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট। তাহলে ইলিয়াস কেন অভিযোগ করছেএমন প্রশ্নে রেজা বলেন, উনি ব্যক্তিস্বার্থের জন্য এগুলো বলে বেড়াচ্ছেন।
এদিকে শাখা ছাত্রলীগের কমিটিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে ইলিয়াসের কয়েক কোটি টাকা লেনদেনের চুক্তি রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার বিরোধীরা। তারা বলেন, যুবলীগের এক সদস্যের মাধ্যমে এ লেনদেনের চুক্তি হয়েছে। কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত ভূমির ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদনকারীর বিপরীতে ইলিয়াস ও যুবলীগের ওই সদস্যের নাম রয়েছে। যদিও ভূমির মালিক তাদের দুজনের কেউই নন এবং যুবলীগ নেতার বাড়িও ওই এলাকায় নয়। ওই ভূমির বিপরীতে ধার্যকৃত টাকার পরিমাণ ৬ কোটি ৯৮ লাখ ৭২ হাজার ১০৬ টাকা।
তবে লেনদেনের বিষয় অস্বীকার করে ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, যুবলীগের ওই সদস্যের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকায় কাগজে তার নাম দিয়েছি। এখানে মোট ২১ জন আছে। তার মধ্যে রেজা-ই-এলাহীও একজন। আমাদের শুধু মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। জমির মালিক আমরা নই।
এসব বিষয়ে কথা বলতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও খুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে লেখক ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ ও নির্বাহী সংসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জাব্বার রাজ বিষয়গুলো অস্বীকার করে বলেন, কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয় কমিটিকে কেন্দ্র করে প্রথম থেকেই গুঞ্জন চলছে। বিষয়গুলো ভিত্তিহীন। মূল সমস্যা হচ্ছে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের। তারা চাচ্ছে নিজেদের মতো করে কমিটি নিয়ে আসতে। এজন্য প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারির নামে এক রকম রটনা তৈরি করে রাখছে।
একই কথা বলেছেন আল নাহিয়ান খান জয়ের ঘনিষ্ঠ ও কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এস এম রিয়াদ হাসান। তিনি বলেন, কারও বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ আসে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসের ভূমি অধিগ্রহণ বাণিজ্য ও মধ্যস্থতা করেই বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছেন রেজা-ই-এলাহী ও ইলিয়াস হোসেন সবুজ। উভয় পক্ষই কমিটি আনতে কোটি টাকা পর্যন্ত দর হাঁকাচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন ক্যাম্পাসে সক্রিয় রাজনীতি করে আসা নেতাকর্মীরা।
কমিটিতে সভাপতি প্রার্থী ও কাজী নজরুল ইসলাম হলের সভাপতি নাজমুল হাসান পলাশ বলেন, অনেকেই রাজপথে রাজনীতি না করে টাকা দিয়ে কমিটি আনতে চায়। রাজপথে রাজনীতি করা লোকদের এত টাকা এবং লবিং থাকে না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে পরিবারের টাকা দিয়ে ক্যাম্পাসে রাজনীতি করে আসছি। কোনো দিক থেকে কোনো টাকা পাইনি। রাজপথের কর্মীদের যদি কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ মূল্যায়ন না করে, তাহলে মূল্যায়ন করার মতো আর কেউ নেই। আদর্শের রাজনীতি করে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে ক্যাম্পাসের ভেতর থেকেই গ্রহণযোগ্য ও যোগ্য নেতৃত্ব চাই। আশা করি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ রাজপথের কর্মীদের নিরাশ করবে না।
শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত জমা নিতে আসা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ছাত্রলীগের কমিটিতে পদবাণিজ্যের সুযোগ নেই। যোগ্য ও যাদের ছাত্রত্ব আছে, শুধু তারাই কমিটিতে আসবে।
সূত্রঃ দেশ রূপান্তর