বাহারের সঙ্গে ফাঁসছেন তার ১৮ সহযোগী
কুমিল্লার বহুল আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার ও তার ১৮ সহযোগীর অবৈধ সম্পদের নথি এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে। এ তালিকায় আছেন বাহারের মেয়ে ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সদ্য বিদায়ী মেয়র তাহসিন বাহার সূচনার নামও। বাহার কত সম্পদের মালিক, তার বিস্তারিত ফিরিস্তি এখনো পায়নি দুদক। তবে প্রাথমিক একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তাকে শতকোটি টাকার মালিক বলা হয়েছে। দুদকে বাহার তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হওয়ার পর সেটা আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের অনুমতি দিয়েছে কমিশন। দু-এক দিনের মধ্যেই এ বিষয়ে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হবে। দুদকের পরিচালক উত্তম কুমার মণ্ডল স্বাক্ষরিত চিঠি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
দুদকের গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও জমা হওয়া অভিযোগের তথ্যমতে, কুমিল্লা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার কুমিল্লার ‘গডফাদার’ হিসেবে পরিচিত। কুমিল্লার রাজনীতিতে তার কথাই ছিল শেষ কথা। তিন কন্যার জনক বাহার অবৈধভাবে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে মেয়ে ডা. তাহাসিনা বাহার সূচনাকে বানিয়েছেন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র।
কামাল হোসেন: দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ মতে, বাহারের এক সহযোগীর নাম কামাল হোসেন। তিনি সাবেক এলজিআরডিমন্ত্রী তাজুল ইসলামের পিএস ছিলেন। ১১ বছর আগেও কামাল পরিবারের ভরণপোষণ দিতে পারতেন না। কামাল ছিলেন পাসপোর্ট অফিসের দালালের সহকারী। পরে কুমিল্লা-৯ আসনের সাবেক এমপি তাজুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয়ে ঘুরে যায় কামালের ভাগ্যের চাকা। আস্তে আস্তে তাজুল ইসলামের বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন কামাল। ২০১৮ সালে তাজুল ইসলাম এলজিআরডিমন্ত্রী হলে কামালকে উন্নয়ন সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব দেন। এই কামাল এক সময় বাহারের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তার মাধ্যমে সব দপ্তর নিয়ন্ত্রণ করতেন বাহার। অনিয়ম ও দুর্নীতি করে এখন শতকোটি টাকার মালিক কামাল।
তার নামে ফ্ল্যাট, ৬ তলা ভবন, বিভিন্ন জায়গায় ৫০ শতক জমি, একটি টয়োটা গাড়ি ও ব্যাংকে গচ্ছিত ৮ কোটি টাকার বেশি সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। শিলংয়ে আছে একটি চা বাগান। সিঙ্গাপুরের বাড়িটি এবং পাচার করা অর্থের সব দেখাশুনা করেন সিঙ্গাপুর প্রবাসী আনিস।
মনিরুল হক সাজু: পিএস কামালের সঙ্গে থেকে তিনিও হয়েছে বিপুল টাকার মালিক। ঢাকায় ৭৮টি ফ্ল্যাটসহ কয়েকটি প্লট ও কানাডায় রয়েছে বাড়ি। ২০টি ব্যাংক হিসাবে তার আছে নগদ ৫০ কোটি টাকা।
আমিনুল ইসলাম টুটুল: সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম টুটুল। তিনি উপজেলার সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ ছাড়া উপজেলায় যে কোনো কাজের জন্য আগে আমিনুলকে ম্যানেজ করতে হতো। কুমিল্লা শহরে যাবতীয় চাঁদাবাজি আয়ের বড় অংশের ভাগ পান এই আমিনুল। তিনিও নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ গড়েছেন। কুমিল্লায় বাড়ি, কয়েকটি মার্কেট, ঢাকায় ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে রয়েছে তার কোটি কোটি টাকা।
আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ: কুমিল্লার যুবলীগের আহ্বায়ক তিনি। ছিলেন কামালের অন্যতম ক্যাডার। বাহারের হয়ে কামাল অন্যের জমি লোকবল নিয়ে দখল করে দিতেন। টেন্ডারবাজির কাজে লোকবল দিয়ে সহযোগিতা করতেন এই মাহমুদ শহীদ। এই প্রক্রিয়ায় তিনি বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
আতিকুল্লাহ খোকন: কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আতিকুল্লাহ খোকন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করে দিতেন তিনি। এ ছাড়াও অবৈধ জমি দখলে পারদর্শী তিনি। অবৈধভাবে করেছেন সম্পদের পাহাড়। নামে-বেনামে ৪২টি দোকান, সদরের অদূরে বাড়ি, ফ্ল্যাট, ঢাকায় ফ্লাটসহ ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা রয়েছে তার।
রিন্টু ও পিয়াস: টেন্ডারবাজি করে কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম রিন্টু। আরও আছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান পিয়াস। তারা বাহারের নাম ব্যবহার করে করেছেন অবৈধ দখল বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি। ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন। অবৈধ কাজে জড়িত থেকে স্ত্রীদের নামেও করেছেন বাড়ি ও ফ্ল্যাট। তাদের নামেও কুমিল্লায় বিপুল জমিসহ কোটি কোটি টাকার তথ্য পেয়েছে দুদক।
শাহরিয়ার সাদী: বাহারের আরেক সহযোগী প্যানেল মেয়র হাবিবুল আল শাহরিয়ার সাদী। তিনি পিএস কামালের সঙ্গে হাত মিলিয়ে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখল চালু রাখেন। কুমিল্লায় একাধিক বাড়ি, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও বেনামে ব্যবসা রয়েছে তার।
হাসান খসরু: পিএস কামালের সঙ্গে মিলে বাহারের ব্যাংকিং বিষয়ে লজিস্টিক সাপোর্ট দিতেন সোনালী ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হাসান খসরু। জাল কাগজপত্র দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ, বিদেশে টাকা পাচারসহ নানা অনিয়মের মূলহোতা এই হাসান খসরু। ঠিকাদারি কাজে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে গড়ে তোলেন নিজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনন্ত এন্টারপ্রাইজ। কালো টাকার পাশাপাশি ঢাকা ও কুমিল্লায় একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট আছে তার।
ফারুক হোসেন: রিভারভিউ সিএনজি স্টেশনের মালিক ফারুক হোসেন। তিনিও কামালের বিশ্বস্ত সহচর। খাসজমি, হিন্দু সম্পত্তি দখল বাণিজ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এ চক্রটি জমি অবৈধ দখল করে বিক্রি করে দেন। এভাবে ফারুক এখন একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফারুকের নামে জমি আছে।
হাসান মাহমুদ: সিবিএ নেতা ও সোনালী ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাসান মাহমুদ সুমন। তিনি পিএস কামালের সঙ্গে মিলে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিভিন্ন ঋণ পাস করিয়ে দেন বাহারকে। তার তদবির বাহার ও কামাল কোটি কোটি ঢাকার মালিক হয়েছেন। এ ছাড়া টেন্ডারবাজি ও বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন হাসান মাহমুদ। এসব অর্থে গড়ে তুলেছেন একাধিক ভবন ও প্লট। দেশের বাইরে ঢাকা পাচার করার বিষয়ে বাহার ও কামালকে সহযোগিতা করতে মাহমুদ।
মহব্বত আলী: সাবেক মন্ত্রী তাজুলের শ্যালক মহব্বত আলী। তিনি লাকসাম উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান। বাহার ও তাজুলের ছত্রছায়ায় থেকে ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন মহব্বত আলী। টেন্ডার বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, দখলদারিত্ব সবই চলত তার তত্ত্বাবধানে।
মঞ্জুর কাদের: তিনি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রক মনি। মনির ঢাকায় ফ্ল্যাট, প্লট, কুমিল্লায় বাড়ি, গাড়ি ও বিভিন্ন জায়গায় জমিসহ দেশের বাইরেও রয়েছে বাড়ি।
তছলিম: তিনি হজ এজেন্সি বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি। বাহার ও কামালের অন্যতম ঘনিষ্ঠ। বাহারের সঙ্গে মিলে টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, দখল বাণিজ্য করে শত শত কোটি টাকা বানিয়েছেন। তিনি বাহার ও মন্ত্রী তাজুলের ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাবের সভাপতি হয়েছেন। ঢাকায় একাধিক বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, কুমিল্লায় বাড়ি, লন্ডনে বাড়ি রয়েছে তার। মালয়েশিয়ায় তার একটি বাড়ি রয়েছে।
হাবিবুর রহমান: বাহারের ভাতিজা হাবিবুর রহমান আল সাদি। তিনিও তাজুলের পিএস কামালের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করেছেন।
কুমিল্লার সব সরকারি প্রতিষ্ঠান বাহারের কবজায়: সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি, ফ্যাসিলিটিস ডিপার্টমেন্ট, সিটি করপোরেশন, জনস্বাস্থ্যসহ সব বিভাগ ছিল বাহারের দখলে। কুমিল্লায় কোনো ঠিকাদার দরপত্র দাখিল করার সাহস পেতেন না। বাহারের লোকজনের বাইরে কেউ টেন্ডার জমা দিতেন না। কুমিল্লার অন্য ১০ সংসদ সদস্যের কেউ তার বিরুদ্ধে প্রশ্নও তুলতেন না। কুমিল্লা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া বাহারের অবৈধ সম্পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার বিষয়টি জাতীয় সংসদে তুলে ধরেছিলেন। ওই ঘটনার পর সুবিদ আলী ভূঁইয়া আর কুমিল্লা সদরে যেতে পারেননি।
শত শত কোটি টাকার সম্পদ বাহারের: সোনালী স্কয়ার শপিং মল (১৪ তলা), টাউন হল সুপার মার্কেট, (বাহার মার্কেট), ঢাকায় বিপুলসংখ্যক প্লট ও ফ্ল্যাট রয়েছে তার। ব্যাংকে রয়েছে বিপুল পরিমাণ অস্থাবর সম্পদ। মালয়েশিয়ায় রয়েছে তাদের সেকেন্ড হোম। সিঙ্গাপুর, দুবাই ও লন্ডনেও কিনেছেন বাড়ি।
বাহারের মেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র তাহছিন বাহার সূচনা গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ঢাকায় তাদের বাড়ি, কুমিল্লায় জমি, গাড়ি, ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা ও জমি। সূচনার ব্যবসার অংশীদার ছিলেন পিএস জামাল।
কুমিল্লার একাধিক নেতা জানান, ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বাহার যখন ব্যাংক ঋণের কারণে নির্বাচন করতে পারছিলেন না। ওই সময় তিনি ছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি। তখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চাঁদা তুলে বাহারের ব্যাংক ঋণ পুনঃতপশিল করে তাকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সেই বাহার এখন কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। বিত্তবৈভবের কোনো অভাব নেই তার। তিনি নিজেই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলে বেড়ান কুমিল্লার শীর্ষ করদাতা তিনি। অল্প দিনের ব্যবধানে তিনি সোনালী স্কয়ার, কুমিল্লা টাউন হল সুপার মার্কেট, ঢাকার উত্তরায় বাড়ি এবং নাইস পাওয়ার অ্যান্ড আইটি লিমিটেড, সোনালি সুইটস লিমিটেড, নাসুয়া অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড, মাইন্ড মুভবার লিমিটেড, এ সিক্স লিমিটেড, এমবি টেক্সটাইল অ্যান্ড ফ্যাক্টরি লিমিটেড এবং গোমতী ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের মতো অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
বাহারের হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়ে ২৮ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজারে। ওই পাঁচ বছরে ‘কাগজে-কলমে’ তার সম্পত্তি বেড়েছে ১৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকার। এর বাইরে বাইরে কোটি কোটি টাকার ব্যবসায়িক মূলধন এবং দামি গাড়ি ও বিলাসবহুল জীবনযাপন তারা।