কুমিল্লা সদর হাসপাতাল হতে পারে দেশের মডেল
বাচ্চু মিয়া বকাউলঃ বাংলাদেশের মফস্বল জেলাতেই এখন বিনামূল্যে মিলছে দূরারোগ্য ব্যধির চিকিৎসা। অতি আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই জটিলতর অপারেশনে সক্ষমতা দেখিয়ে আসছেন স্বদেশী-স্বভাষী চিকিৎসকগণ। এতেই প্রমাণ হয় বিচক্ষণ ও গুণি আর্ন্তজাতিক মানের অসংখ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সারাদেশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। যদিও সারাদেশেই কিছু প্রতারক নিম্নমানের চিকিৎসকের বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় এবং চিকিৎসা ব্যবসায়ীদের ভীরে এই সদজ্ঞানী মহামানবগণ নিজেদের অনেকটা আড়াল করেই রাখেন। এর পরও তাঁদের কীর্তির কিছু খবর বাতাস বয়ে বেড়ায়, জানিয়ে দেয়। অসৎদের দমিয়ে এই জ্ঞানীদের স্বীকৃতি দিলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম তাঁরা। আর তখনি ফি বাবদ বছরে শত কোটি টাকার বিদেশী চিকিৎসা ব্যয় থেকে মুক্তি এবং দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি সকল মানুষের ভক্তি ও চিকিৎসকগণের প্রতি আস্তা ফিরে পাবে জাতি।
দেশের কোন মানুষকেই আর মৃত্যুভীতির সংঙ্কামুহুর্তে সহায়-সম্পদ খুঁইয়ে আধুনিক চিকিৎসার খোঁজে আর দেশ ছাড়তে হবে না। যদিও বর্তমান সরকার দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা দেখিয়ে আসছে। এরই অংশ হিসেবে কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা: মো: মুজিবুর রহমান বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন। ভূয়া ‘ডা:’ চিহ্নিত এবং আটক, অনুমোদনহীন হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনোষ্টিক সেন্টার বন্ধে লাগাতার অভিযান পরিচালনা করে আসছেন তিনি।
পৃথিবীর অনেক দেশেই মন্দ কাজ বিরল ঘটনা বলে বিবেচিত হয়, অথচ আমাদের দেশে এর উল্টো। কোন একজন একটি ভালো কাজ করলে ‘বিরল’ ঘটনা বলে প্রচার পায়, অপরকে উৎসাহিত করতে। এমনই এক তোলপাড় করা বিরল ভালো ঘটনা ঘটিয়েছে কুমিল্লার একদল চিকিৎসক। তবে একেবারে বিখ্যাত কিংবা উঁচুদরের কোন হাসপাতালে নয়, বর্তমান রাষ্ট্রের অবহেলিত এবং গরীব মানুষের বিনামূল্যের চিকিৎসালয় হিসেবে পরিচিত কুমিল্লার সদর হাসপাতালে। সমাজের পিছিয়ে পড়া অর্থ-বিত্ত, সহায়-সম্বলহীন গরীব জাতির বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসাস্থল এই ‘সদর হাসপাতাল’।
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার তেলিপাড়া গ্রামের হযরত আলীর শিশুকন্যা লতা আক্তার (১২)। একান্ত দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া লতা তাঁর মামার পরিবারের সাথে কুমিল্লা মহানগরীর কালিয়াজুরী এলাকায় বাস করে।লতা দীর্ঘ দিন চিকিৎসাহীনতার পর পেটের ব্যাথা নিয়ে ভর্তি হয় কুমিল্লা অঞ্চলের সকল মানব সম্প্রদায়ের ভরসাস্থল ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর হাসপাতালটির দায়িত্বরত চিকিৎসকগণ নিশ্চিত হন যে, লতার বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ। লতাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করলে বর্তমান বাজার দর অনুযায়ি অন্তত ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা খরচ করতে হবে। দরিদ্র লতার পিত্তনালীতে টিউমার হয়েছে। এ টিউমার অপসারণ করে পিত্তনালীর সাথে খাদ্যনালীর সংযোগ স্থাপন করতে হবে।
অত্যন্ত জটিল ও ব্যবহুল এ অপারেশনের অর্থনৈতিক দায় নেবে কে? এ প্রশ্নেই হয়তো ‘বনলতা’ ভেবে লতাকে কুমিল্লার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ত্যাগের ছাড়পত্র দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বেঁচে থাকার প্রত্যাশা শুধু মানুষ নয় সকল প্রাণীই করে থাকে, অপর কোন প্রাণীকে হত্যা করে হলেও। দূর্বল সত্ত্বার অধিকারী লতাদের সেই সাধ্য নেই, অপর কোন প্রাণের বিনিময়ে নিজের প্রাণ বাঁচানোর। তাঁরা বাঁচতে চান রাষ্ট্রের একান্ত কৃপায়-দয়ায়। এই বাঁচার মানসে জীবনের শেষ চিকিৎসার জন্য লতাকে নিয়ে আসা হয় কুমিল্লার সদর হাসপাতালে। লতার কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে অতীত অভিজ্ঞতা আর মনের জোরে ভর্তি রাখেন কুমিল্লার সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
লতাকে দেখে মানবতাবাদী চিকিৎসকগণ নিশ্চিত হয়েছেন লতার পরিবারের পক্ষে এতো টাকা ব্যয় করা সম্ভব নয়, তাই অচীরেই ক্ষয়ে যাবে সে। লতাকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নেন একদল অত্যন্ত অভিজ্ঞ চিকিৎসক। এই চিকিৎসক দলকে সাহস ও উৎসাহ প্রদান করেন কুমিল্লার সুযোগ্য সিভিল সার্জন ডা: মো: মুজিবুর রহমান। কুমিল্লা সরকারি সদর হাসপাতালের অর্থায়নে শুরু হয় প্রস্তুতি। প্রায় ৪ ঘন্টার জন্য লতার প্রাণপাখি হাতের মুঠোয় ভরে নিতে এনেস্থেশিয়া টিমে সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা: রেজাউল ইসলাম, কনসালটেন্ট ডা: মঈন উদ্দিন আহম্দ ও মেডিকেল অফিসার ডা: জামশেদ আলী অত্যন্ত সুক্ষভাবে কাজ সম্পন্ন করেন। অবশেষে সার্জন টিমে সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারী) ডা: জাহাঙ্গীর হোসেন ভূইয়া, সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা: সফিউল আজম মিঠু, কনসালটেন্ট ডা: আমিনুল ইসলাম, সহকারি রেজিষ্টার ডা: কামরুল হাসান ও সহকারি রেজিষ্টার ডা: উর্মি পারভীন ছুরি-কাঁচি-যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রবেশ করেন লতার নিথর দেহের কাছে।
৪ ঘন্টার অধিক সময় ধরে অপারেশনের পর সফলতার হাসি হাসেন এনেস্থেশিয়া ও সার্জন টিমের সকল সদস্য। অপারেশন শেষে লতা চোখ মেলে তাকানোর পর এনেস্থেশিয়া ও সার্জন টিমের সকল সদস্য যেন উৎসবে মেতে ওঠেন। নানান চড়াই-উৎরাই পেড়িয়ে লতা এখন এখনো বেঁচে আছেন এবং ভালোই আছেন। লতার জন্য দীর্ঘজীবন কামনা করছেন এনেস্থেশিয়া ও সার্জন টিমের সকল সদস্যরা, যাদের হাতে লতা পূন:জীবন পেয়েছেন। লতার অদৃশ্য আত্মার চীরদিনের প্রার্থনায় এই এনেস্থেশিয়া ও সার্জন টিমের সকল সদস্য এবং সিভিল সার্জন ডা: মো: মুজিবুর রহমান ধন্য হোক। এগিয়ে যাক তাদের পথচলা। পথ দেখায় কেউ কেউ, পথ চলে সবাই। মানবতা প্রতিষ্ঠিত হোক, তাঁদের হাত ধরেই।
আলাপকালে সিভিল সার্জন ডা: মো: মুজিবুর রহমান জানিয়েছেন, গত সপ্তাহেই এমন আরো একটি অপারেশনে সফলতা দেখিয়েছেন সদর হাসপাতালের এই এনেস্থেশিয়া ও সার্জন টিম।
জানা গেছে, কুমিল্লা মহানগরীর রামনগর এলাকার গৃহবধু ফারজানা (৩৫) কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভর্তি হন। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকগণ নিশ্চিত হন যে দরিদ্র ফারজানার দূর্বল অগ্নাশয়ে নালীতে পাথর জন্মেছে। প্রকৃতি প্রদত্ত এ পাথর অপসারণ করে অগ্নাশয়নালীর সাথে খাদ্যনালীর সংযোগ স্থাপন করতে হবে। জটিল এ অপারেশনের বিরাট ব্যয়-ভার বহন করা ফারজানার পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। এমনটি জেনে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তাকে বের করে দেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সেখান থেকে ফিরে নিরুপায় ফারজানার আশ্রয় হয় কুমিল্লা সদর হাসপাতাল। কুমিল্লার সদর হাসপাতালের এনেস্থেশিয়া ও সার্জন টিম ফারজানার ক্ষেত্রেও সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। সদর হাসপাতালের এনেস্থেশিয়া ও সার্জন টিম কাজে প্রমান দেন যে, মানুষের ইচ্ছার কাছে অর্থের লোভ-লালসা পরাভূত হয়। যার যা আছে তা’ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে হিংসা-লোভ-ভয়কে মানুষ জয় করতে সক্ষম। মানবতার যে বাণী নিয়ে চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রবেশ করেছিলেন সেই আদর্শ বজায় রেখে মা-মাটি-মানুষের ঋণ পরিশোধে সর্বদাই নিবেদিত সদর হাসপাতালের এনেস্থেশিয়া ও সার্জন টিম। এ সত্য এখন জানান দেয়ার সময় এসেছে।
সিভিল সার্জন ডা: মো: মুজিবুর রহমান জানান, কুমিল্লা সদর সরকারি হাসপাতালে এখন প্রতি সপ্তাহে ৬/৭টি সফল অপারেশন হয়ে থাকে। কুমিল্লা সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বিভিন্ন পদে প্রায় ৭শ’র মতো পদ খালি পড়ে আছে। দীর্ঘ দিন ধরে লোকবল নিয়োগ বন্ধ থাকায় হাসপাতালগুলোতে সংকট বাড়ছে। কুমিল্লা সদর হাসপাতালে স্বল্প মূল্যে এক্স-রেসহ বিভিন্ন পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। তবে, সময়ের প্রয়োজনে এখন জরুরী আধুনিক একটি আল্ট্রাসনো মেশিন দরকার।
তিনি বলেন, কুমিল্লা সদর সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজি আ. ক. ম বাহাউদ্দিন বাহারের আন্তরিকতায় কুমিল্লা সদর হাসপাতাল এখন সেই আগের অবস্থায় নেই। এই হাসপাতাল এলাকায় কোটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক ‘সিভিল সার্জন কার্যালয়’ নির্মাণ হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে লোকবল সংকটের সমাধান হলে এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির যোগান দিলে চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে মানুষের হয়রানি অনেকাংশেই কমে আসবে। বিশেষ করে সমাজের পিছেয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমানের প্রভূত উন্নতি হবে। দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মানুষের মাঝে যে বিভ্রান্তি আছে এরও অবসান হবে।
কুমিল্লা সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারী) ডা: জাহাঙ্গীর হোসেন ভূইয়া বলেন, গত কিছু দিন আগে এই হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছেন হাজি আ. ক. ম বাহাউদ্দিন বাহার এমপি। তাঁর একটি ছোট অপারেশনকালে অপারেশন থিয়েটারে হাজি বাহার এমপি’র কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে গরীব মানুষ আসে’। এ কথা বলতেই হাজি বাহার এমপি সাফ উত্তর দেন- ‘কুমিল্লা সদর হাসপাতাল এখন আগের অবস্থায় নেই, এখন পরিবেশ অনেক পরিবর্তন হয়েছে, ভালো চিকিৎসক আছেন, এটি নিশ্চিত হয়েই তিনি এখানে এসেছেন’। ডা: জাহাঙ্গীর হোসেন ভূইয়া জানান, নিজের অপারেশন শেষে শত বছরের পুরনো এই হাসপাতাল ভবনটি সংস্কার করতে তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন হাজি বাহার এমপি।
সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারী) ডা: জাহাঙ্গীর হোসেন ভূইয়া বলেন, সরকারি হাসপাতালে এতোকাল শুধু গরীব মানুষের চিকিৎসা সেবা দিয়েছি। এখন সম্ভ্রান্ত লোকজন আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসায় মনে হচ্ছে, আমরা ব্যর্থ হইনি, আমরা আমাদের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে শুধু প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় সহায়তা; মানসিক সহায়তা, আর্থিক সহায়তা, পরিবেশগত সহায়তা। সরকারের সহায়তা পেলে বাংলাদেশ থেকে কোন মানুষ আর বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে হবে না, বাংলাদেশেই বিদেশীরা চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে আসবে।
আলাপকালে তিনি খোলামেলা করে বলেন, বাংলাদেশের চিবিৎসাব্যবস্থায় সিনিয়র চিকিৎসকদের একটি প্রথা আছে। অপারেশনকালে জুনিয়রদের কাছে রাখতে চান না, পাছে তাঁরা শিখে ফেলবে সেই জন্য। এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। তিনি বলেন, একজন চিকিৎসককে জীবনভর পড়ালেখা করতে হয়, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয়। আজকে যারা জুনিয়র কালকে তাঁরা সিনিয়র হবে, এক সময় তাঁরাই এই পেশার হাল ধরবে। আজকে তাঁদের না শেখালে কালকে তাঁরা সফল হবে কী করে। তিনি বলেন, তাঁর সঙ্গীদের তিনি অপারেশনকালে ডেকে আনেন, হাতে-কলমে শিখিয়ে দেন। কী ভাবে সফল হওয়া যায় সেই দীক্ষা দিয়ে যেতে চান তিনি।
তিনি বলেন, যে কোন অপারেশনের সফলতার পেছনে এনেস্থেশিয়া টিমের সফলতা জড়িত। এনেস্থেশিয়ার উপরই অনেকাংশে নির্ভর করে অপারেশনের সফলতা-ব্যর্থতা। কুমিল্লা সদর হাসপাতালের এনেস্থেশিয়া টিমের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা: রেজাউল ইসলামসহ এই টিমের সকলকে ধন্যবাদ জানান সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারী) ডা: জাহাঙ্গীর হোসেন ভূইয়া। ডা: জাহাঙ্গীর হোসেন ভূইয়ার মতে, এনেস্থেশিয়া টিমের দূরদর্শিতার কারনেই কুমিল্লা সদর হাসপাতালের সুনাম বাড়ছে। সিভিল সার্জন ডা: মো: মুজিবুর রহমানের কল্যাণেই কুমিল্লার চিকিৎসাব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে এবং কুমিল্লা সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিৎসা সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে বলে একই সাথে তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা: মো: মুজিবুর রহমানকে।