কুমিল্লা টাউন হল সুপারমার্কেট শতকোটির সম্পদ টানা ৩২ বছর ভোগদখল বাহারের

অবৈধভাবে পছন্দের লোকজনকে কমিটিতে বসিয়ে ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনের প্রায় শতকোটি টাকার জমিতে বহুতল মার্কেট তৈরি করেছিলেন সদর আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। এর পর প্রায় ৩২ বছর ধরে তিনি মার্কেটটি থেকে আয় করেন বিপুল অর্থ।
নির্মাণ ও পরবর্তী সময়ে দোকানের পজেশন বিক্রি করে হাতিয়ে নেন প্রায় ৬ কোটি টাকা। শুধু দোকান ও আবাসিক হোটেলের ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে ১৭ লাখের বেশি টাকা পেয়েছেন বিতর্কিত এই এমপি।
নগরীর কেন্দ্রস্থলের এই টাউন হল সুপারমার্কেটটি ‘বাহার মার্কেট’ নামে পরিচিত। সরকার পতনের পর বাহার ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ী ও তৎকালীন বীরচন্দ্র গণপাঠাগারের দায়িত্বশীল নেতারা মুখ খুলতে শুরু করেন। অবশেষে বাহারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে যাচ্ছে এ মার্কেট।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৮৮৫ সালে বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন প্রতিষ্ঠিত হয়, যা কুমিল্লা টাউন হল নামে পরিচিত। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে ১০ বিঘা জমিজুড়ে এর বিস্তৃতি।
অর্থ সংকট দূর করার ছুতায় কৌশলে ১৯৮৯ সালে টাউন হলের ২০ শতক ভূমির ওপর সুপারমার্কেট নির্মাণ করেন বাহার। বর্তমানে ওই সম্পত্তির বাজারমূল্য শতকোটি টাকার বেশি বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ডেভেলপার কোম্পানির প্রধান জানিয়েছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, প্রথমে এর নাম ছিল হকার্স মার্কেট। টাউন হল কর্তৃপক্ষ ১৯৯০ সালে ওই স্থানে ছোট ছোট দোকান বানিয়ে সামান্য ভাড়ায় নগরীর কান্দিরপাড় এলাকার ভাসমান দোকানিদের পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেয়। এর পর ১৯৯২ সালে মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাহারের চুক্তি হয়। মার্কেট নির্মাণ প্রসঙ্গে টাউন হলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক দুলাল সমকালকে জানান, এটি তাঁর আমলে বাহারকে ইজারা দেওয়া হয়।
ইজারার শর্ত ছিল, ঠিকাদার হিসেবে বাহার তাঁর নিজের টাকায় ভবন তৈরি করবেন এবং এ জন্য ১০ বছরের ভাড়া নেবেন। শর্তে ছিল, ভাড়া থেকে কিছু অংশ টাউন হলকে প্রদান করবেন। ওই চুক্তিতে সময় বাড়ানোর শর্ত না থাকলেও পরবর্তী সময়ে বাহার তাঁর পছন্দের লোক দিয়ে টাউন হলের কমিটি সাজিয়ে দফায় দফায় ১০ বছর করে সময় বাড়িয়ে নেন।
সরকার পতনের পর টাউন হলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক পলাতক। নাম না প্রকাশের শর্তে কমিটির একজন সদস্য জানান, সর্বশেষ ২০২২ সালের শেষের দিকে ইজারা চুক্তির মেয়াদ ২০৩২ সাল পর্যন্ত বাড়িয়ে নেন বাহার।
যেভাবে বাহারের পকেটে ঢুকেছে টাকা
মার্কেট কমিটির একাধিক নেতা জানান, টাউন হল সুপারমার্কেটের নিচতলায় ১০০টি দোকান রয়েছে। শুরুতেই বাহার এসব দোকানের পজেশন বিক্রির নামে ৩০ হাজার টাকা করে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। বর্তমানে প্রতি দোকান থেকে তিনি ১ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে ১ লাখ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন। দ্বিতীয়তলায় রয়েছে ৪২টি দোকান। বাহার এগুলো নিজের আয়ত্তে রেখে ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত পজেশন বিক্রি করে প্রায় ৬ কোটি টাকা নিয়েছেন। এসব দোকান থেকে প্রতি মাসে এক শাটারে ১ হাজার ৬০০ ও দুই শাটারের জন্য ৩ হাজার ২০০ টাকা করে ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা নিচ্ছেন।
তৃতীয় ও চতুর্থতলায় রয়েছে বাহারের মেয়ে সোনালীর নামে আবাসিক হোটেল। সেখানে ছোট-বড় ২৮টি রুম আছে, যা থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকা বাহারের পকেটে যাচ্ছে। বাহারের প্রতিষ্ঠান মেসার্স কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট সাপ্লাইয়ারের রসিদে দোকানের ভাড়ার টাকা তোলা হয়। এভাবে প্রতি মাসে আবাসিক হোটেল ও দোকানের ভাড়া বাবদ প্রায় ১৭ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেন বাহার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টাউন হল কমিটির একজন সদস্য জানান, এ মার্কেট থেকে সাবেক এমপি বাহার প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ টাকা নিলেও টাউন হলের অ্যাকাউন্টে জমা দেন মাত্র ২২ হাজার ৫০০ টাকা। তিনি টাকার পাহাড় বানালেও অর্থের অভাবে টাউন হলটির পাঠাগারের চেয়ার কেনা যায় না। বিদ্যুৎ বিল ও কর্মচারীর বেতনও দেওয়া যায় না।
সম্প্রতি টাউন হল সুপারমার্কেটের দোকানদারদের একটি প্রতিনিধি দল কুমিল্লার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাতের পরই গণপাঠাগারের অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসের ভাড়ার টাকা জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়ছার বলেন, দোকানদের কাছে পজেশন কেনার বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। এতদিন মুখে মুখে সব চলছিল। এখন থেকে গণপাঠাগারের অ্যাকাউন্টে ভাড়ার টাকা জমা দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন ও গণপাঠাগার পরিচালনায় টাউন হল মিলনায়তনে অতিরিক্ত সাধারণ সভা হয়। এ সভায় আগের কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠন ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রক্ষাসহ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
তিনি আরও জানান, বীরচন্দ্র গণপাঠাগারের উন্নয়নে জেলা পরিষদ থেকে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। টাউন হল ভবনটির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে স্থাপত্য পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। পুনঃসংস্কার করে ৫০ বছর আগে দরজা-জানালা যেভাবে ছিল, সেভাবে তৈরি করে নতুন রূপে সাজানো হবে।
সূত্রঃ সমকাল