রেশমের সুদিন কুমিল্লায়
ডেস্ক রিপোর্টঃ বিন্দু আকৃতির ডিম, ডিম থেকে রেশম কীট। এ রেশম কীট রেশম কেন্দ্রের ভিতর চাষকৃত তুত পাতা খেয়ে তৈরি হয় রেশম গুটি এবং রেশম গুটি থেকে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হয় মূল্যবান সুতা। ঐতিহ্যবাহী এ রেশম শিল্পের সঙ্গে বর্তমানে জড়িত আছে বহু মানুষের জীবন-জীবিকা।
উন্মুক্ত বাণিজ্যের প্রভাবে বিদেশি সুতার বাজার দখলে গেলেও দেশীয় রেশম সুতা ও এ সুতায় তৈরি কাপড়ের এখন খুব কদর। স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে তুত গাছ ও রেশম কীট নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে রেশম উৎপাদনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ারও বেশ সুযোগ রয়েছে। সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কারণে সুদিনে ফিরছে রেশম শিল্প। এখন দেশব্যাপী প্রসারিত হচ্ছে রেশম চাষ।
জানা গেছে, কুমিল্লার ময়নামতিতে অবস্থিত বস্ত্র মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত ও বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের রেশম উৎপাদন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি রেশম চাষে সফলতা এসেছে। ক্রমেই লাভজনক পর্যায়ে যাচ্ছে এ কেন্দ্রটি। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লার ময়নামতির রেশম শিল্প উৎপাদন আর গবেষণা কেন্দ্রটির আয়তন ৪৮ বিঘা। এর মধ্যে ২৮ বিঘায় রেশম বাগান এবং বাকি অংশে কার্যালয়, রেশম উৎপাদন এবং প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। এ কেন্দ্রের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয় হওয়ার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শত শত লোককে স্বাবলম্বী হবার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। স্বল্প জনবল দিয়েই তাদের সফলতা এসেছে।
কর্তৃপক্ষ জানায়, রেশম চাষে শুধু গ্রামের বা শহরের অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত নারীদেরই তুত চাষ ও পলু (রেশম কীট) সম্পর্কে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে সরকারের প্রচেষ্টার কারণে কুমিল্লা ছাড়াও দেশের অন্যান্য স্থানে সম্ভাবনাময় এ রেশম শিল্প ক্রমেই সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাঙ্গামাটি ও পার্বত্য এলাকায়ও এর চাষ ক্রমেই বাড়ছে।
তুত পাতা থেকে রেশম গুটি তৈরির প্রক্রিয়া
বিন্দু আকৃতির ডিম, ডিম থেকে রেশম কীট আর এ রেশম কীট এ রেশম কেন্দ্রের ভিতর চাষকৃত তুত পাতা খেয়ে তৈরি হয় রেশম গুটি, আর রেশম গুটি থেকে তৈরি হয় মূল্যবান সুতা। এখানে একটি রেশম মথ থেকে ৪০০/৫০০ ডিম সংগ্রহ করা হচ্ছে। এখানে আগে ১০০ ডিমে মাত্র ২০/২৫ কেজি রেশম গুটি উৎপাদিত হলেও বর্তমানে একই পরিমাণ ডিমে উৎপাদিত হচ্ছে ৫০-৫৫ কেজি রেশম গুটি। জাত উৎপাদন ও ময়নামতিতে উৎপাদিত রেশম বা তুত গাছের মধ্যে রয়েছে বিএম-৩, বিএম-৪, বিএম-৬, বিএম-১০, বিএম-১১ ছাড়াও উন্নতমানের স্থানীয় ও থাই প্রজাতির চারা। এই গাছের পাতা দিয়েই রেশম বা গুটি পোকার খাদ্য সরবরাহ করা হয়। অপর দিকে এ কেন্দ্রে ২৫টি উন্নত জাতের রেশম কীট রয়েছে, যার মাধ্যমে নারী–পুরুষ জাতের ক্রসের মাধ্যমে প্রজনন প্রক্রিয়ায় উন্নত জাতের রেশম ডিম ও বাচ্চা (রেশম কীট) উৎপাদন করা হয় । ২৫টি উন্নত জাতের রেশম কীটের মধ্যে রয়েছে পিওর জাতের ১৪টি, দেশি ৬টি, বিদেশি ৮টি, হাইব্রিড ৯টি। শুরু থেকে পূর্ণাঙ্গ গুটি তৈরি হতে সময় লাগে ৩ সপ্তাহ।
স্বল্প পুঁজিতে বেশি লাভ
রেশম চাষে সামান্য বিনিয়োগ করে তুত গাছ ও রেশম কীট নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে রেশম উৎপাদনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার বেশ সুযোগ রয়েছে। কুমিল্লার ময়নামতি রেশম উৎপাদন গবেষণা কেন্দ্রে মাতৃ-পিতৃ জাত রেশম উৎপাদনের গবেষণার দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় বলে কর্তৃপক্ষ জানায়। কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক কাঞ্চন বরণ দাশ জানান,একটি ডিম ফোটালে ৪০০ রেশম কিটের বাচ্চা পাওয়া যায়, এরকম একশ ডিমের দাম মাত্র ২০৫ টাকা; যা থেকে ৪০ হাজার রেশম কিট পাওয়া যায়। একশ ডিম ও পরে কিটের মাধ্যমে ৩০/৪৫ কেজি গুটি পাওয়া যায়। প্রতি কেজি গুটি ৩০০ টাকায় বিক্রি করা যায়। তিনি বলেন, একটি উন্নত মানের শাড়ি তৈরিতে ২ কেজি গুটিই যথেষ্ট। এখানকার রেশম কীট দেশের বিভিন্ন শিল্প ইউনিটে বিশেষ করে রাজশাহী ঝিনাইদহ, ঠাকুরগাঁও, আইআই আরডি (এনজিও), ব্র্যাক, কারিদাস ইত্যাদি স্থান ও এনজিওগুলোতে তাদের চাহিদা অনুযায়ী পাঠানো হয়।
এখানে শীত-গ্রীষ্ম সব ঋতুতে উন্নত দেশি ও বিদেশি জাতের রেশম উৎপাদন করা হয়। এ ময়নামতিতে রেশম বা গুটি পোকা পালনের তিনটি ঘর, রেশম সূতা তৈরির একটি কারখানা, ল্যাবরেটরি, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রাখার ঘর, ডরমেটরি, প্রশিক্ষণার্থীদের থাকার জন্য ৪০ বেডের ব্যবস্থা রয়েছে। গত অর্থবছরে ময়নামতি রেশম কেন্দ্রে ডিম উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১০ হাজার; প্রতি একশ ডিম ২০৫ টাকা দরে পার্বত্য এলাকায় ওই ডিম বিক্রি করা হয়। চলতি অর্থবছরের শুরুতে গত ৩ মাসে ৪ হাজার ডিম উৎপাদিত হয়েছে, বাকি সময়ে গত ৯ মাসে ১২/১৫ হাজার ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে বলে জানা গেছে। অন্য দিকে গত অর্থবছরে ২৫ হাজার তুত গাছের চাড়া উৎপানের পর খাগড়াছড়ি জেলায় ১০ হাজার, ফেনীতে ১০ হাজার এবং কুমিল্লার নাঙ্গলকোট ও সদর দক্ষিণে ৫ হাজার চারা সরবরাহ করা হয়। প্রতিটি চাড়ার মূল্য মাত্র ৫০ পয়সা।
প্রসার ঘটছে রেশম শিল্পের প্রসারে রেশম উন্নয়ন বোর্ড
দেশের রেশম শিল্পের যখন দৈন্য দশা, ২০০১ সালে তখন বস্ত্র মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ সিল্ক ফাউন্ডেশনকে ১৫ বছরের জন্য ময়নামতিসহ দেশের অন্যান্য রেশম কেন্দ্রের চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব দেয়া হয়। পরর্তীতে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে এ শিল্পের দায়িত্ব নেয় বস্ত্র মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড। বর্তমানে রেশম উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি,ঝিনাইদহ,রাজশাহী,ঠাকুরগাও, ফেনী, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটিসহ বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত রেশম উৎপাদন, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, রেশম শিল্পকে আরও লাভজনক করতে বিদেশি সুতা ও বস্ত্রের আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেশের রেশম শিল্পকে বাঁচাতে এই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। রেশম চাষীদের বেশিরভাগ প্রান্তিক ভূমিহীন। তাদের যথেষ্ট পরিমাণে মূলধন নেই। প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতাও অপ্রতুল। তাদের উৎপাদিত সুতা ও গুটি বাজারজাত করায় প্রতিবন্ধকতা দূর করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২ অর্থবছরে অন্তত ১৫ লাখ তুঁত চারা উৎপাদন ও বিতরণ করা হয়। এর সংখ্যা বর্তমানে ২০ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। বর্তমানে গড়ে প্রতি বছর ৪০০ টনেরও বেশি রেশম গুটি উৎপাদিত হয়। একই সঙ্গে প্রায় প্রায় ৫০ টন রেশম সুতা উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু রাজশাহী ও ঠাকুরগাঁও রেশম কারখানার শিল্প ইউনিটে রেশম সুতার চাহিদা রয়েছে আরও অনেক বেশি। সরকারের কর্মপরিকল্পনায় অনেক জেলায় সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে রেশম চাষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আওতায় বর্তমানে ৩৫ জেলার ৯৫টি উপজেলাসহ সহস্রাধিক চাষী তুঁতগাছ চাষ করছেন। ক্রমেই এ সংখ্যা বাড়ছে। কুমিল্লার ময়নামতি রেশম উৎপাদন,গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি রেশম চাষে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এ কেন্দ্রে ১০ জনবলের মধ্যে মাত্র ৩ জন সরকারি আর কাজের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিদিন ৮/১০ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক নিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম চলছে। বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে সেখানে।
ময়নামতি রেশম কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক কাঞ্চন বরণ দাশ বলেন, প্রয়োজনীয় জনবল ও অর্থ বরাদ্দ সঙ্কটে থাকলেও উৎপাদন ও গবেষণার মাধ্যমে ডিম, গুটি ও চারা উৎপাদনে এ রেশম কেন্দ্র লাভজনক পর্যায়ে রয়েছে। স্বল্প পুঁজিতে যে কেউ বাড়িতে বসেও রেশম চাষে এগিয়ে এলে সব ধরনের সহায়তা করা হয়ে থাকে। তিনি বলেন, দেশে রেশমী সুতার এখনো যথেষ্ট চাহিদা থাকলেও বিদেশি সুতা ও নকল রেশমী সুতায় বাজার দখল করার কারণে দেশীয় এ শিল্পে সুদিনে ফিরতে এখনও নানা বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
সূত্রঃ জাগোনিউজ