কুমিল্লায় বিক্রিতে শীর্ষে খাদি কাপড়ের পাঞ্জাবি
ঈদ যতোই ঘনিয়ে আসছে, ততই লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠছে কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন শপিং সেন্টারগুলো। এবার এই জেলায় ঐতিহ্যবাহী খাদি পোশাক ও কাপড়ের বাজারে চাহিদার শীর্ষে রয়েছে পাঞ্জাবি ও ফতুয়া। খাদি কাপড়ে তৈরি থ্রি-পিসও প্রচুর বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) বিকেলে নগরীর বেশ কয়েকটি খাদি দোকানে গিয়ে দেখা যায়, দোকাগুলোতে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে খাদি বিক্রেতারা বাহারী ডিজাইনের বিভিন্ন জামা কাপড়ের কালেকশনে দোকান সাজিয়েছেন। এসব দোকানে শোভা পাচ্ছে পুরুষদের জন্য খাদি কাপড়ের পাঞ্জাবি ও ফতুয়া। আর নারীদের প্রিয় খাদির থ্রি-পিস। সেই সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে খাদি কাপড়ের তৈরি বিছানার চাদর ও নকশি কাঁথা। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশেলে এ বছর নানা ধরনের নকশায় তৈরি করা হয়েছে খাদি পোশাক।
কয়েকজন বিক্রেতারা সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দাম অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষের কাছে খাদি পোশাকের কদর বেশি।
কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড় এলাকার লাকসাম রোডের খাদি জ্যোৎস্না স্টোরের মালিক রতন পাল ও তপন পাল জানান, এখনো দেশ-বিদেশে খাদি কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ২০২০ সালের ঈদুল ফিতরে লকডাউনের কারণে দোকানপাট বন্ধ থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েন কুমিল্লার ঐহিত্য খাদি শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। এছাড়া পরের বছর করোনার প্রকোপের কারণে ভাটা পড়ে খাদি কাপড় বিক্রিতে। তবে গত বছরের রোজার ঈদ থেকে প্রাণ ফিরতে শুরু করে খাদি শিল্পের। রমজানের শুরু কয়েকদিন মন্দা থাকলেও বর্তমানে বেচাকেনা খুবই ভালো। মানে ভালো দামে কম হওয়ায় মানুষ খাদি পোশাক কিনছেন। ক্রেতাদের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে পাঞ্জাবি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা জেলায় খাদি কাপড় বিক্রির অন্তত তিন শতাধিক দোকান রয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র কুমিল্লা নগরীতেই রয়েছে দুই শতাধিক দোকান। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ভারত পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে নিলে কুমিল্লার খাদিশিল্পে সঙ্কট দেখা দেয়। পরবর্তীতে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হাল ধরেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খান। খাদের (গর্তে) চরকায় বসে এ কাপড় তৈরি করা হয় বলে এর নামকরণ হয় ‘খাদি’।
কুমিল্লা জেলা সদর ছাড়াও চান্দিনা, দেবিদ্বার উপজেলায় এখনো ঐতিহ্যগতভাবে খাদি কাপড় তৈরি হয়। হাতের পাশাপাশি মেশিনেই বর্তমানে বেশি খাদি কাপড় তৈরি হচ্ছে। এজন্য মোটা খাদি কাপড় এখন মিহি হয়েছে। কাপড়ে লেগেছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। বর্তমান খাদির পাঞ্জাবি, শার্ট, প্যান্ট, ফতুয়া, চাদর ও থ্রিপিস বিক্রি হচ্ছে পুরো দেশেই। কুমিল্লার ঐতিহ্যের খাদি কাপড় যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও।
কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড় এলাকার খাদি কুঠির শিল্প ভবনের পরিচালক অরূপ সরকার বলেন, খাদি কাপড় কুমিল্লার ঐতিহ্যের প্রতীক। এক সময় খাদির সব পণ্যেরই ব্যাপক চাহিদা ছিলো দেশ-বিদেশে। কিন্তু বর্তমানে ভারতীয় কাপড়ের আগ্রাসনে খাদির থ্রি-পিসসহ অন্যান্য কাপড়ের আগের মতো চাহিদা নেই। বর্তমানে মানুষের চাহিদা বেশি খাদি পাঞ্জাবিতে। আমরা ক্রেতাদের কাছে বেশি পাঞ্জাবি আর ফতুয়া বিক্রি করছি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড়, মনোহরপুর ও রাজগঞ্জ এলাকার দোকানগুলোতে খাদির বিভিন্ন পোশাক বেশি বিক্রি হচ্ছে। এ বছর খাদি পোশাকগুলোর মধ্যে সাদা ও রঙিন পাঞ্জাবি সর্বনিম্ন ৪০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা, মেয়েদের থ্রিপিস ৪০০ থেকে ২ হাজার টাকা, শর্ট ফতুয়া ৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা, শাড়ি ৫০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা, শার্ট ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা দামে মিলছে। এছাড়া বিছানার চাদর ৩০০ থেকে ৬ হাজার টাকা এবং নকশি কাঁথা ৩ থেকে ৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল হাসনাত বাবুল বলেন, খাদি কাপড়ের বুননে বৈচিত্র আসায় নারী-পুরুষ সবার কাছে যুগের পর যুগ ধরে এর জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন রয়েছে। ঈদ, নববর্ষ ও পূজা উপলক্ষে খাদির পাঞ্জাবি, ফতুয়া, থ্রিপিস ও শাড়ির বেশ চাহিদা সব সময়ই থাকে। এক সময় খাদি কাপড় অনেক ভারি ছিল। তবে এখন ওই কাপড় প্রতিনিয়ত মিহি করা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম এখন খাদি নিয়ে ভাবছে। এদের হাত ধরেই খাদি কাপড়, খাদি পাঞ্জাবি ও ফতুয়ার নকশায় বৈচিত্র্য আসছে। আমার বিশ্বাস তরুণ প্রজন্ম কুমিল্লার খাদিকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।
কুমিল্লা নগরীতে খাদি কাপড় কিনতে আসা শাহাদাত হোসেন বলেন, প্রতি বছরই ঈদে খাদির পাঞ্জাবি পরিধান করি। ৫০০-৬০০টাকার মধ্যে খাদির ভালোমানের পাঞ্জাবি পাওয়া যায়। এছাড়া খাদির পাঞ্জাবি দেখতেও বেশ সুন্দর আর পরতেও আরাম লাগে। তাই তরুণরা ঈদে খাদির পাঞ্জাবি বেশি কিনছে। আর পরিবারের মেয়েদের জন্য খাদি থ্রি-পিস কিনেছি। দামও মোটামুটি বাজেটের মধ্যেই ছিল।
জান্নাতুল ফেরদৌস নামের অপর এক ক্রেতা বলেন, আমি নিয়মিত বাসায় খাদির থ্রি-পিস পরি। বাসার অন্যরাও খাদির জামা পছন্দ করে। এছাড়া খাদি কাপড়ের দামও সামর্থের মধ্যে। তাই এবারের ঈদের জন্য খাদি জামা কিনতে এসেছি।